মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও তাদের দোসর’রা রাখাইন রাজ্যের মানব শূন্য গ্রামগুলোতে হানা দিয়ে বাড়িগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছে। হাট-বাজার-গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন দোকানে লুটপাটের পর আগুন দিচ্ছে। গ্রামের নলকূপ থেকে পুকুরের পানি পর্যন্ত নষ্ট করে দিচ্ছে। এই অবস্থায় বন-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা রোহিঙ্গারা খাদ্য সংকটে পড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে।
মঙ্গলবার ভোরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে খেয়াংমং থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের কুতুপালং মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ফাতেমা বেগম (২৮) এসব করুণ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে কেঁদে উঠেন। তিনি জানান, তাদের দীর্ঘদিনের সঞ্চিত সহায় সম্বল বুকে আঁকড়ে ধরে, জীবন বাজি রেখে মাতৃভূমিতে থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সামরিক জান্তারা তাদের খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী ধ্বংস করে দেওয়ার কারণে সেখানে আর থাকা হয়নি। আরো প্রায় ২৫ হাজার রোহিঙ্গা সাথে ফাতেমা বেগম থাইংখালী সীমান্ত দিয়ে নাফনদী পার হয়ে ভোরে কুতুপালং এসে পৌঁছেছেন বলে জানান। তিনি আরও জানান, তারা দিনের বেলায় জঙ্গলে ও রাতের আঁধারে ঘরবাড়িতে থাকার চেষ্টা করেছিল। মিয়ানমার জান্তারা একথা জানতে পেরে তাদের সহায় সম্বলগুলো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়।
রাখাইনের শিলখালী গ্রামের আবুল কালাম (৩৫) জানায়, তার বসতবাড়িতে ধান চালসহ নিত্য পণ্যের মজুদ ছিল। ছিল গোলা ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, শতাধিক হাঁস-মুরগি। এসবের মায়া ত্যাগ করতে না পেরে পরিবার পরিজনদের নিরাপদে বাংলাদেশে পৌঁছে দিয়ে সে নিজ বাড়িতে থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু জান্তারা সোমবার সকালে এসে তার দোতলা কাঠের ঘরটি জ্বালিয়ে দেয়। নিঃস্ব হয়ে তাকে এপারে চলে আসতে হয়েছে। এরকম প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মঙ্গলবার ভোর রাতে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এপারে চলে এসেছে। কুতুপালংয়ের স্থানীয় ইউপি সদস্য মুফিজ মেম্বর জানায়, তিনি রাত দেড়টার দিকে শোরগোল শুনে বাড়ি থেকে বের হন। দেখেন শত শত রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু নাফনদী পার হয়ে তার বাড়ির পাশ দিয়ে থাইংখালীর দিকে যাচ্ছে।
পালংখালী ইউনিয়নের ইউপি সদস্য সোলতান আহমদ জানান, গত রাতের মতো রোহিঙ্গা করুণদৃশ্য সে আর কখনো দেখেনি। আসার পথে ভাই আব্দুস সালামের (৫৫) মৃত্যু, দুই রোহিঙ্গা দম্পতির রোগাক্রান্ত দুই শিশু মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে মায়ের বুকে লুকিয়ে রয়েছে। তৎমধ্যে একটি শিশু দুগ্ধ পোষ্য। মায়ের দুধ না পেয়ে ওই শিশুটির মৃত্যু হয়েছে বলে শিশু হারা রোহিঙ্গা গৃহবধূ ছকিনা বেগম (২৮) কান্না জড়িত কণ্ঠে সাংবাদিকদের জানান। তারা আরো জানায়, টানা সাতদিন দুর্গম পাহাড়ি পথে কোন খাবার পাননি। কেবল হেঁটেছেন এপারে চলে আসার জন্য। হাঁটার পথে ওই শিশুর করুণ মৃত্যু নিয়ে এলাকার মানুষের মাঝে দেখা দেয় বিষণ্ণতা। এসব রোহিঙ্গারা পালংখালী ইউনিয়নের বাঘঘোনা নামক স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে আশ্রিত আজিম উল্লাহ বুচিডং শীতলক্ষ্যা এলাকার কোয়ামং এলাকার বাসিন্দা। স্ত্রী ও ৯ সন্তান নিয়ে ৬ দিনে আগে পাড়ি জমান এদেশে আসার উদ্দেশ্যে। তাদের মংডু এলাকায় মিয়ানমার জান্তারা খাবার না দিয়ে দু’দিন আটকিয়ে রাখে, সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে ৪দিন পর মঙ্গলবার ভোর রাতে এপারে এসে পৌঁছেছে।
জাতিসংঘের তথ্য মতে আগামী ৬ মাসে আরো তিন লাখ রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে আসতে পারে। যেহেতু মিয়ানমার সেনারা রাখাইন রাজ্যের কৃষকদের বাড়িতে মজুদ থাকা খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পুড়িয়ে দেওয়ায় সেখানে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। ইউএনএইচসিআরের ঢাকা প্রধান সিনজি কুবো বলেছেন, রাখাইনের সহিংসতা থামাতে দেশটির সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় দিন গুনছে তাদের প্রতিনিধিদল। ২৫ আগস্ট থেকে দেড় মাসে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সংখ্যা পাঁচ লাখ সাত হাজারে উন্নীত হওয়ার কথা তারা স্বীকার করলেও মূলত এসংখ্যা আরো বেশি হতে পারে বলে বিভিন্ন এনজিও সংস্থা মনে করছেন। এ প্রসঙ্গে ক্যাম্পের সার্বিক দায়িত্বরত এক সেনা কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ থেকে প্রতিদিন ৬০/৭০ পরিবারের রোহিঙ্গা বালুখালী, কুতুপালং, থাইংখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। স্থানীয় পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, আনজুমানপাড়া, থাইংখালী, বালুখালী ও ধামনখালী সীমান্ত দিয়ে প্রতিরাতেই রোহিঙ্গারা দলে দলে এ দেশে পাড়ি জমাচ্ছে।