এশিয়া ও ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের প্রথম দিনেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে প্রবল চাপে পড়েছে মিয়ানমার। নেপিডোতে গতকাল সোমবার সকালে এশিয়া ইউরোপ মিটিংয়ের (আসেম) ১৩তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠকের আগে রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেছিল দেশটি।
সেখানে মিয়ানমার ছাড়াও অংশগ্রহণকারী এশিয়া ও ইউরোপের ১৫টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশদ কয়েকটি বিষয়ে অনেকটা অভিন্ন প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন। তাঁরা অনতিবিলম্বে সংঘাত বন্ধ, রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী স্রোত থামানো এবং বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁরা আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
বার্তা সংস্থা ইউএনবি জানায়, রাখাইন রাজ্য ইস্যুতে গতকাল সকালে একটি অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। এতে মিয়ানমার, বাংলাদেশ, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, এস্তোনিয়া, জার্মানি, মাল্টা, রাশিয়া, লুক্সেমবার্গ, ফ্রান্স, থাইল্যান্ড, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ অংশ নেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী শান্তি ও উন্নয়নের প্রতি বাংলাদেশের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। তিনি সংখ্যালঘুসহ সবাইকে নিয়ে এবং সবার অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করে টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের ওপর জোর দেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রান্তিকীকরণ ও মৌলিক অধিকার হরণের ফলে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়। এটি বাস্তুচ্যুতি ও পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করতে পারে।
তিনি শান্তি ও উন্নয়নের জন্য অংশগ্রহণ ও সহনশীলতাকে উৎসাহিত করতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
এদিকে অনানুষ্ঠানিক ওই ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যে আগ্রহ দেখিয়েছেন তাতে উচ্ছ্বসিত হয়ে ফেদেরিকা মগেরিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ একটি চুক্তিতে পৌঁছবে বলে তিনি আশাবাদী। সু চির সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি উৎসাহিত বোধ করছেন।
তবে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির অবস্থান ছিল বেশ কৌশলী। দুই দিনব্যাপী আসেম বৈঠকের প্রথম দিনে তিনি তাঁর বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ ইস্যুটি কার্যত এড়িয়ে গেলেও বিশ্বব্যাপী অস্থিতিশীলতা, সংঘাত ও সন্ত্রাসের কারণ হিসেবে অবৈধ অভিবাসনকেই দায়ী করেছেন। সু চি রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ নিয়ে বৈশ্বিক সমালোচনার কোনো জবাব দেননি। তবে তাঁর বক্তব্যে যে মনোভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হলো মিয়ানমারের জনগণ রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী এবং সন্ত্রাসের জন্য দায়ী মনে করে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যে দমন-পীড়ন অভিযান শুরু করে, তাতে এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে গত তিন মাসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ছয় লাখ ২২ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা।
সু চি গতকাল তাঁর আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে বলেন, সারা বিশ্ব নতুন নতুন হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। অবৈধ অভিবাসনের কারণে সন্ত্রাস, উগ্রবাদ, সামাজিক বিবাদ, এমনকি পরমাণু যুদ্ধের ঝুঁকি বাড়ছে। তিনি বলেন, সংঘাত সমাজ থেকে শান্তি কেড়ে নেয়। দারিদ্র্য ও অনুন্নয়নের কারণে জনগণ এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমায়।
আসেম বৈঠক উপলক্ষে এশিয়া ও ইউরোপের ৫১টি দেশ ও দুটি জোটের সচিবালয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী/প্রতিনিধিরা মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে সমবেত হয়েছেন। চীন, জাপান, জার্মানি, সুইডেন ও ইইউয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিয়ানমারে যাওয়ার পথে বাংলাদেশ সফর করে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা কক্সবাজারে সরেজমিনে গিয়ে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখেছেন। তাঁরা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন।
ইইউয়ের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মগেরিনি গতকাল সকালে আসেম বৈঠক শুরুর আগেই সু চির সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা করেছেন। এরপর ফেদেরিকা মগেরিনি সাংবাদিকদের বলেন, সোম ও মঙ্গলবার এশিয়া ও ইউরোপের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করবেন। উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে সু চির সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতি নিয়ে স্টেট কাউন্সেলর (মিয়ানমারের) অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠককে আমার কাছে অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক মনে হয়েছে।
বাংলাদেশ সফরকালে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত আশাবাদী। আর এটিই হবে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের প্রথম ধাপ।
ফেদেরিকা মগেরিনি বলেন, ‘এ ইস্যুতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার—উভয়কেই কাজ করতে আমরা উৎসাহিত করছি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একে সমর্থন দেবে। ’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, সহিংসতা বন্ধ করা, শরণার্থীর স্রোত থামানো, রাখাইন রাজ্যে পূর্ণ মানবিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ নিশ্চিত করা এবং শরণার্থীদের নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসন বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সোমবার সকালে আমাদের প্রথম, অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আমি উৎসাহ বোধ করছি। ’
ফেদেরিকা মগেরিনি মিয়ানমারে চলমান গণতন্ত্রায়ণ প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের জোরালো সমর্থনের কথা জানান। তিনি বলেন, গণতন্ত্রায়ণে মিয়ানমারকে সমর্থন দেওয়া আমাদের অগ্রাধিকার। একই সঙ্গে আনান কমিশনের সুপারিশগুলো মিয়ানমারকে বাস্তবায়ন করতে হবে।
ফেদেরিকা মগেরিনি মনে করেন, সু চি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের পথে আছেন। রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহযোগিতা দেবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সমালোচনা ও চাপ এড়াতে মিয়ানমার যখন বিদেশি অতিথিদের দৃশ্যত এড়িয়ে চলছিল, তখন আসেম বৈঠক নেপিডোতে বসেই মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির এক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দৃশ্যত এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশ। ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তাবিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ ফেদেরিকা মগেরিনি গতকাল আসেম বৈঠকের আগে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাঁদের প্রত্যাশার কথা কেবল সু চির কাছেই নয়, সাংবাদিকদের কাছেও গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
গত সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখার সময় পাওয়া খবরে জানা গেছে, ফেদেরিকা মগেরিনি নেপিডোতে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আসেমের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে ফেদেরিকা মগেরিনি রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জোর দিয়েছেন। গতকাল প্লেনারি বৈঠকের আগে সু চির সঙ্গে বৈঠকে রাখাইন রাজ্য পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করেন। এ ছাড়া তিনি গত রবিবার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতাও তুলে ধরেন।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ইউরোপ ও এশিয়ার মন্ত্রীদের অংশগ্রহণে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকের প্রস্তুতিও নেন সু চি ও ফেদেরিকা মগেরিনি। সেখানে তিনি রাখাইন রাজ্যে সংঘাত বন্ধ করা এবং সেখানে মানবিক সহায়তা কর্মীদের অবাধ প্রবেশাধিকার চান। এ ছাড়া তিনি রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি সই এবং আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদ দেন।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকেও বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন বিষয়েও আলোচনা করেন।
এদিকে আসেম বৈঠকের ফাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী গতকাল সুইজারল্যান্ড, হাঙ্গেরি, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁরাও দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষ করে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরে যাওয়া এবং টেকসই সমাধানের ওপর জোর দেন। আজ আসেমের বৈঠকের পর আরো দুই দিন অর্থাৎ আগামীকাল বুধ ও পরশু বৃহস্পতিবার মিয়ানমারে অবস্থান করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ওই সময় দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে একটি চুক্তির চেষ্টা চালাবে।
বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান চায়। তবে মিয়ানমারের আন্তরিকতার ঘাটতি থাকায় এ ইস্যুতে দেশটির ওপর বৈশ্বিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে বাংলাদেশ এবং দৃশ্যত তাতে সফলও হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমারে সংকটের মূলে দেশটির সামরিক বাহিনী। এ কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীকেও চাপ দিচ্ছে।