ছয় দিনের এশিয়া সফরে প্রথমবারের মত রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করে পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, মিয়ানমারের এই নিপীড়িত মুসলিম জনগোষ্ঠীর মাঝেও ঈশ্বর আছেন।
সেই সঙ্গে তিনি আহ্বান জানিয়েছে, শরণার্থী, নিপীড়িত সংখ্যালু, দরিদ্র আর বিপদগ্রস্ত মানুষকে বিশ্ব যেন ভুলে না যায়।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, শুক্রবার ঢাকার সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তিনটি পরিবারের ১৬ জন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে, তাদের দুর্দশার কথা নিজের কানে শুনে আবেগময় এক সন্ধ্যা কাটে পোপের।
পোপ বলেন, “আজ ঈশ্বরের যে উপস্থিতি, তা বিরাজমান রোহিঙ্গা রূপেও।”
রোমান ক্যাথলিকদের শীর্ষ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস এশিয়া সফরে এসেছেন এমন এক সময়ে, যখন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর ব্যাপক দমন-পীড়নের মুখে সোয়া ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সেনাবাহিনী কীভাবে নির্বিচারে মানুষ মারছে, ধর্ষণ, লুটপাট করছে, সেই বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কথায়। ওই অভিযানকে জাতিসংঘ বর্ণনা করেছে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে।
বিভিন্ন সময়ে শরণার্থীদের অধিকারের প্রশ্নে এবং তাদের দুর্দশা লাঘবে সরব হওয়া পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমার সফরে রোহিঙ্গাদের বিষয়েও তার দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরবেন বলে অধিকার সংগঠনগুলোর প্রত্যাশা ছিল।
মিয়ানমারে দেওয়া ভাষণে পোপ সম্প্রীতির ডাক দিয়ে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীকে সম্মান দেখানোর আহ্বান জানালেও ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি উচ্চারণ না করায় বিষয়টি সংবাদের শিরোনাম হয়।
বৃহস্পতিবার মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পৌঁছে বঙ্গভবনে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও কূটনীতিকদের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে শরণার্থী সঙ্কট নিয়ে কথা বলেন পোপ।
মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ায় তিনি বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং এ সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশের পাশে থাকতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু এ বক্তৃতাতেও তিনি রোহিঙ্গা শব্দটি এড়িয়ে যান।
বাংলাদেশ সফরে পোপ যে রোহিঙ্গাদেরও সাক্ষাৎ দেবেন, তা আগেই জানানো হয়েছিল। সে অনুযায়ী কক্সবাজারের কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের তিনটি পরিবারকে নিয়ে আসা হয়েছিল ঢাকায়। শুক্রবার বিকালে কাকরাইলের অনুষ্ঠানে তাদের সঙ্গে দেখা হয় পোপের।
রয়টার্স লিখেছে, সর্বধর্মীয় সম্প্রীতি সভার শেষভাগে ওই তিন রোহিঙ্গা পরিবারের ১২ পুরুষ আর চার নারী সদস্য যখন দোভাষীর মাধ্যমে তাদের নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন, পোপের মুখে তখন খেলা করছিল বিষাদের ছায়া।
পোপ তাদের বলেন, “যারা তোমাদের ওপর পীড়ন চালিয়েছে, যারা তোমাদের আঘাত করেছে, তাদের পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাইছি। তোমাদের মহৎ হৃদয়ের কাছে আমার আবেদন, আমাদের ক্ষমা কর।”
বাংলাদেশ সফরের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় আশি হাজার ভক্তের অংশগ্রহণে এক প্রার্থনাসভায় পৌরহিত্য করেন পোপ। সেখানে তিনি যিশুর বাণীর আলোকে সবাইকে শান্তি ও সম্প্রতির পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান।
দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় ভ্যাটিকান দূতাবাসে গিয়ে পোপের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সে সময় প্রায় ২০ মিনিট একান্তে কথা হয় তাদের মধ্যে।
এরপর বিকালে কাকরাইলের সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রালে যান পোপ ফ্রান্সিস। তিনি ক্যাথিড্রাল পরিদর্শন করেন এবং পরে বাংলাদেশের বিশপদের সঙ্গে বিশেষ সভা করেন।
পরে বিকাল ৫টার পর রিকশায় চড়িয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আর্চবিশপ হাউজের মাঠে বিশাল তাবুর নিচে আয়োজিত ‘সম্প্রীতি ও শান্তি’ শীর্ষক আন্তঃধর্মীয় ও আত্মমাণ্ডলিক সমাবেশ।
এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ, আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, ভারতের রাষ্ট্রদূত হর্ষবর্ধন শ্রীংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান, কলামনিস্ট আবুল মকসুদসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধিরা।
রাজধানীর তেজগাঁও রেলওয়ে জামিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার শতাধিক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এবং হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের মিলিয়ে এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ।
পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে গঠিত মিডিয়া কমিটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সম্প্রীতি ও শান্তি সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য দেন ঢাকার আর্চবিশপ কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও। পোপের বক্তৃতার আগে ছিল বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।
পোপ ফ্রান্সিস তার বক্তৃতায় বলেন, ধর্মীয় স্বাধীনতা বাংলাদেশের একটি মৌলিক নীতি, এই প্রতিশ্রুতি অতিসূক্ষ্ম, তবুও শক্তভাবে তা তাদের প্রত্যাখান করে- যারা বিভেদ সৃষ্টিতে ইন্ধন যোগায় এবং ধর্মের নামে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে।
“প্রতিবেশীর মঙ্গল করার ধর্মীয় চেতনা উৎসারিত হয় আমাদের উন্মুক্ত হৃদয় হতে যা প্রবাহিত হয়ে বাইরের দিকে বিশাল নদীর মতো, সিক্ত করে শুষ্ক ভূমি, নির্বাপিত করে ঘৃণার নিষ্ফলা পতিত ভূমি, ধ্বংস করে দুর্নীতি, মুক্ত করে দরিদ্রতা থেকে। সহিংসতা আমাদের মানব জীবনের কতই ক্ষতি করে, পরিবারকে ভেঙে দেয় এবং সৃষ্টিকে করে বিকৃত, বিবর্ণ।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় সেই মুক্ত হৃদয়ের পথ বেছে নিয়েছে মন্তব্য করে পোপ বলেন, বিশ্বে এখন সেই মুক্ত হৃদয়ের স্পন্দন শক্তিশালীভাবে দরকার।
“রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি মোকাবিলা করার জন্য, ধ্বংসাত্মক ধর্মীয়ও মতবাদ প্রত্যাখান করার জন্য, দরিদ্রদের প্রয়োজনের দিকে চোখ বন্ধ করে না রাখতে, শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে, সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন বন্ধ করতে এবং যারা সমাজে অত্যন্ত দুর্বল ও ভঙ্গুর তাদের যত্ন নিতে আমাদের সেই হৃদয় স্পন্দন প্রয়োজন।”
সফরের শেষ দিন শনিবার সকালে তেজগাঁওয়ে মাদার টেরিজা হাউজ পরিদর্শনে যাবেন পোপ। এরপর তেজগাঁও হলি রোজারিও চার্চে খ্রিস্টান যাজক, ধর্মগুরু ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে চার্চের কবরস্থান পরিদর্শন করবেন। দুপুরের পর ঢাকায় নটরডেম কলেজে তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময়ও করবেন।
সফরের ইতি টেনে বিকাল ৫টায় শাহজালাল বিমানবন্দর ছাড়বেন ক্যাথলিক ধর্মগুরু। তাকে বিদায় জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।