নিজস্ব প্রতিবেদক : সাতক্ষীরার সাধারণ মানুষের উপর ডিবি পুলিশের অবর্ণনীয় অত্যাচার, আটক বাণিজ্য ও হয়রানির একের পর দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে নবাগত পুলিশ সুপারের কাছে এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ চাইলেন সাতক্ষীরার সাংবাদিকবৃন্দ। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সাথে নবাগত পুলিশ সুপারের এক মতবিনিময় সভায় এ দাবি করলেন জেলায় কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীরা। এসপি মো. সাজ্জাদুর রহমান এসময় সকলকে আশ্বস্ত করে বলেন, “আপনাদের মাধ্যমে আমি সাতক্ষীরার সর্বস্তরের মানুষকে জানাতে চাই- পুলিশের দ্বারা কোন নিরীহ মানুষ যাতে হয়রানি না হয় সে বিষয়ে আমি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করব।”
একই সাথে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করে ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ত থেকে দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিয়েছিল তাদেরকে বয়কট করার আহবান জানিয়ে সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার সাজ্জাদুর রহমান বলেন ‘তাদের মাথার ওপর থেকে রাজনৈতিক ছাতা সরিয়ে নিন’।
তিনি বলেন, সাতক্ষীরায় পুলিশের দায়িত্ব গ্রহণ একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পুলিশ আন্তরিকতা ও স্বচ্ছতার সাথে কাজ করবে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন বিনা কারণে গ্রেফতার বন্ধ করা হবে। একই সাথে পুলিশ যাতে কেবলমাত্র সমাজের অপরাধীদের ভীতির কারণ হয় সেই দায়িত্বই পালন করা হবে।
সাতক্ষীরার ২৫তম পুলিশ সুপার হিসাবে বুধবার রাতে যোগদানের কয়েক ঘণ্টা পর এসপি সাজ্জাদুর রহমান বৃহস্পতিবার তার সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সাথে মতমিনিময় কালে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন সাধারণ মানুষ যাতে পুলিশের দ্বারা হয়রানি না হয় সে ব্যাপারে পুলিশবাহিনী সতর্ক থাকবে। ‘পেন ইজ মাইটার দ্যান সোর্ড’ একথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ ও সাংবাদিকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে পুলিশের বর্তমান অবস্থান জিরো টলারেন্সÑ জানিয়ে তিনি আরও বলেন মাদকের ক্রেতা বিক্রেতা এবং ব্যবহারকারী একই অপরাধে অপরাধী। এ ছাড়া সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধের ক্ষেত্রেও পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকবে। গোয়েন্দা পুলিশের পরিচয় বহন করে কেউ যাতে নিরীহ মানুষকে ফাঁদে জড়াতে না পারে সে ব্যাপারে পুলিশ সতর্ক থাকবে বলে জানান তিনি। এসব ঘটনার সাথে পুলিশের কোনো সদস্যের সম্পৃক্ততা থাকলে তাও কঠোর হস্তে দমন করা হবে। তিনি পুলিশ ও সাংবাদিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সকলের প্রতি আহবান জানান।
মতবিনিময় সভায় খুব দ্রুত শহরে ট্রাফিক শৃংখলা ফিরিয়ে আনা হবে মন্তব্য করে সাজ্জাদুর রহমান বলেন, খুব শীঘ্রই গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)’র কর্মকা-ও সমন্বিত করা হবে।
মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। এ সময় আলোচনায় উঠে আসে সাতক্ষীরায় কয়েকজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলা এবং তাদের গ্রেফতারে কার্যকর পদেক্ষপ গ্রহণ না করা, সাক্ষীদের নিরাপত্তার বিষয়ে ঔদাসীন্য, কয়েকজন জঙ্গির নিখোঁজ থাকার বিষয়, শহরে প্রচুর পরিমাণে পুলিশ কর্মকর্তাদের সাধারণ পোশাকে রিভলবার প্রদর্শন করে ঘুরে বেড়ানো, মাদক ব্যবসায়ী ও নাশকতার মদদদাতাদের কারও কারও সাথে কোন কোন পুলিশ কর্মকর্তার ঘনিষ্ঠতা, ঢাকায় র্যাব পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত জঙ্গি মুকুল রানা, মতিয়ার রহমান, রোহান ইমতিয়াজের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়, সুন্দরবনের জলদস্যুদের উৎপাত ও তাদের আত্মসমর্পণ, সীমান্তে ভারতীয় গরুর খাটাল পরিচালনা ইত্যাদি।
এ ছাড়াও সাংবাদিকেদের বক্তব্যে আরও উঠে আসে বিদায়ী পুলিশ সুপারের যোগদানের পরপরই পাটকেলঘাটা থানা এলাকা থেকে আটক তিন কেজি সোনা গায়েবের নেপথ্য তদন্ত কাহিনি, পুলিশের আচরণে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়া, হরিণ শিকার করে এক পুলিশ কর্মকর্তার ফ্রিজে ৩৫ কেজি হরিণের মাংস রাখা, বিভিন্ন সময়ে পুলিশের কনস্টেবল নিয়োগে দুর্নীতি, গাড়ি থামিয়ে বা ট্রাক আটকে পুলিশের চাঁদাবাজি, রাতে বহু জনকে আটক করে পরদিন আদালতে সামান্য কয়েকজনকে হাজির করা, যেকোনো ব্যক্তিকে ধরে তার পকেটে ফেনসিডিল ঢুকিয়ে দেওয়া, শহরের বিভিন্ন স্থানে মেয়েদের উত্ত্যক্তকরণ, মাদক সেবন, বিক্রি কিংবা বহন, পুলিশ পরিচয়ে গ্রেফতারের পর ৩৫ দিন রেখে পরে আদালতে দুটি নাশকতার মামলা দেওয়া, সাতক্ষীরার এক দরিদ্র নারীর কাছ থেকে দফায় দফায় ঘুষ আদায়, সাতক্ষীরার সাইফুল্ল্যাহ লস্কর হত্যা, স ম আলাউদ্দিন হত্যা, আলতাফ হত্যা এবং শেখ হাসিনার গাড়ি বহরে হামলার মতো পেছনের অনেক ঘটনাসহ নানা বিষয়। একই সাথে পুলিশের নানা সফলতার কথাও উঠে আসে। তবে ঘুরে ফিরে সাংবাদিকদের প্রায় সকলেই ডিবি পুলিশের লাগামহীন হয়রানির প্রসঙ্গ তোলেন। পুলিশ সুপার এসব বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন তিনি স্বচ্ছতা এবং সততার সাথে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে চান।
বহু সাংবাদিকের সরব উপস্থিতিতে মত বিনিময় সভায় বক্তব্য রাখেন, আবু আহমেদ, কল্যাণ ব্যানার্জি, সুভাষ চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, মমতাজ আগহমেদ বাপী, হাফিজুর রহমান মাসুম, মনিরুল ইসলাম মিনি, আবদুল ওয়াজেদ কচি, আবদুল বারী, এম কামরুজ্জামান, রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, বরুন ব্যানার্জি, আবুল কাসেম, হাফিজুর রহমান মাসুম, ফারুক মাহবুবুর রহমান, গোলাম সরোয়ার, অসীম চক্রবর্তী, আহসানুর রহমান রাজীব প্রমুখ সাংবাদিক। তারা জেলার নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে এর প্রতিকার দাবি করেন।
এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কেএম আরিফুল হক, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মেরিনা আক্তার, সদর থানার ওসি মারুফ আহমেদ, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের পরিদর্শক মিজানুর রহমানসহ পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সাতক্ষীরায় ডিবি পুলিশের হয়রানি বন্ধে নবাগত পুলিশ সুপারের কঠোর পদক্ষেপ চাইলেন সাংবাদিকরা
পূর্ববর্তী পোস্ট