জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে শাসকদল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট হচ্ছে। জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপ্রাপ্তির প্রতিযোগিতার পাশাপাশি আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ঘিরেই এই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে তাই উদ্বিগ্ন দলটির অনেক নেতাকর্মী। দ্রুত এই দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন করতে না পারলে সম্ভাব্য প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করা খুবই কঠিন হবে বলে মনে করছে তারা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
যদিও আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত নয় পুরোপুরি। তা সত্ত্বেও সাংগঠনিক কোন্দল নিরসন করার উদ্যোগ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। গতকাল শনিবার ঢাকায় ডেকে জয়পুরহাট ও নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলেছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। দুই জেলার নেতাদের নিয়ে বৈঠক দুটি হয়েছে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে। আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে যাওয়া কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক সফরেও দলীয় কোন্দলের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
রাজধানী থেকে শুরু করে সারা দেশে মহানগর, জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও কোন্দল রয়েছে আওয়ামী লীগে। এ নিয়ে সংঘর্ষও হচ্ছে কোথাও কোথাও। এ অবস্থায় বিবদমান বিভিন্ন পক্ষের জেলা পর্যায়ের দলীয় নেতা, সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রদের নিয়ে বৈঠক করে কোন্দল মেটাতে চেষ্টা করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা। দলীয় সূত্রে জানা যায়, সর্বশেষ গতকাল জয়পুরহাট ও নাটোরের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের কয়েকজন সদস্য। কোন্দল মেটানোর এমন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট নেতারা।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ বলেন, ‘দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল থাকলে অবশ্যই নির্বাচনে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। সামনে যে নির্বাচন আসছে সেটা একটা কঠিন নির্বাচন হবে। তাই আগামী ২৬ জানুয়ারি থেকে আমাদের যে সাংগঠনিক সফর শুরু হচ্ছে, সেখানে সিনিয়র নেতারা মন্ত্রী-এমপিদের সঙ্গে জেলার নেতা এবং দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের যে কোল্ড ওয়ার চলছে তা নিরসনের চেষ্টা করবেন।’
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বলেন, ‘আমরা ঢাকায় ডেকে আজ (শনিবার) জয়পুরহাট ও নাটোর জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বসে কথা বলেছি। সামনে সাংগঠনিক ট্যুরে জেলা শহর থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায়ে যাব। সেখানে কোথাও কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব থাকলে তা নিরসন করা হবে। কারণ সংসদ নির্বাচনের আগে আমরা দলকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে চাই।’
গত ১৬ নভেম্বর রাজধানীতে মহানগর আওয়ামী লীগের দুই পক্ষ প্রকাশ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বিষয়টি নিয়ে বেশ আলোচনাও হয়। আজিমপুর পার্ল হারবার কমিউনিটি সেন্টারে দক্ষিণ আওয়ামী লীগ বর্ধিত সভার আয়োজন করলে আগেই কমিউনিটি সেন্টারের গেটে ময়লা ফেলে রাস্তা বন্ধ করে দেয় প্রতিপক্ষ গ্রুপ। বিষয়টি নিয়ে দুই পক্ষ আওয়ামী লীগ সভাপতির কাছে পর্যন্ত যায়। পরে বিবদমান দুই পক্ষকে নিয়ে বৈঠক করে বিরোধ মীমাংসার চেষ্টা করা হয়।
ঢাকার বাইরে এই চিত্র আরো ভয়াবহ। বিভিন্ন স্থানে সংবাদ সম্মেলন পাল্টা সংবাদ সম্মেলন ও ‘বহিষ্কারের’ ঘটনাও ঘটেছে। এমন এক ঘটনায় উত্তেজনা রয়েছে রাজশাহীর বাগমারায়। সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সংসদ সদস্য এনামুল হককে জঙ্গিবাদের আশ্রয়দাতা বলে অভিযোগ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলাম সান্টু। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়নের অভিযোগও আনেন তিনি। পরে জেলা আওয়ামী লীগ বৈঠক ডেকে সান্টুকে ‘বহিষ্কার’ করে। অবশ্য সান্টুর দাবি, বহিষ্কার নয়, পদ থেকে অব্যাহতির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জেলা আওয়ামী লীগ। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের কোনো সদস্যকে বহিষ্কার করার এখতিয়ার জেলা কমিটির নেই। তারা এ বিষয়ে কেবল সুপারিশ পাঠাতে পারে কেন্দ্রের কাছে।
বাগমারা উপজেলা চেয়ারম্যান জাকিরুল ইসলাম সান্টু বলেন, ‘যাঁরা বিগত দিনে জঙ্গি বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন, এমপি এনামুল হক তাঁদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরেন। তাঁর কাছে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোনো স্থান নেই। মূলত এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। এ ছাড়া তিনি সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চান—এটাও দ্বন্দ্বের আরেকটা কারণ।’
এ ব্যাপারে সংসদ সদস্য এনামুল হক বলেন, ‘জাকিরুল ইসলাম সান্টু ছাড়া আওয়ামী লীগের সবাই আমার সঙ্গে আছেন।’ জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সরেজমিনে এসে দেখা উচিত আমার সঙ্গে কারা আছে।’ তিনি জানান, গত ৯ বছরে তাঁর নির্বাচনী এলাকায় কোনো জঙ্গি একটা পটকাও ফোটাতে পারেনি। আর যাদের বহিষ্কার করা হয়েছে, তারা কোনো দিন নৌকার পক্ষে ছিল না। নৌকায় ভোটও দেয়নি।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের জের ধরে গত বছরের ১০ নভেম্বর হবিগঞ্জের বাহুবলে হামলার শিকার হন জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী। এর প্রতিবাদে এবং হামলাকারীর শাস্তি দাবিতে সেখানে টানা আন্দোলন করে কেয়া চৌধুরীর সমর্থকরা। ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুজন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তবে দলীয়ভাবে বিষয়টি সুরাহা না হওয়ায় দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা এখনো রয়েছে। কেয়া চৌধুরী ও তাঁর সমর্থকরা ওই ঘটনার জন্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু জাহিরকে দায়ী করে আসছে। কেয়া চৌধুরী বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করায় তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
অভিযোগের বিষয়ে অ্যাডভোকেট আবু জাহির বলেন, ‘অভিযোগ করাটা সহজ। কিন্তু এর সত্যতা কতটুকু? এর কোনো সত্যতা নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমার একজন সহকর্মী, আমি কেন তাঁর ওপর হামলা করাব?’ তিনি আরো বলেন, ‘উনি (কেয়া চৌধুরী) যেখানে (বাহুবল) নির্বাচন করতে চান সেখানকার জাতীয় পার্টির এমপির সঙ্গে তাঁর দূরত্ব রয়েছে।’ বর্তমানে কারাগারে থাকা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিরোধের বিষয়টিও তিনি উল্লেখ করেন। অ্যাডভোকেট আবু জাহির দাবি করেন, বক্তব্য দিতে গিয়ে সংসদ সদস্য কেয়া চৌধুরী উত্তেজিত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর ওপর কেউ হামলা চালায়নি।
জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ফরিদুল হক খান দুলালের সঙ্গে সংরক্ষিত আসনের সদস্য মাহজাবিন খালেদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। মাহজাবিন খালেদ আগামী নির্বাচনে জামালপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী। ওই আসনের বর্তমান এমপি ফরিদুল হক খান দুলাল। মূলত দ্বন্দ্বটা ওই মনোনয়ন পাওয়ার বিষয় নিয়ে।
সংসদ সদস্য ফরিদুল হক খান দুলাল বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মাহজাবিন খালেদকে নমিনেশন দেবেন না বলে দিয়েছেন। তার পর থেকেই মাহজাবিন আমাকে ফেল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। কিন্তু চেষ্টা করেও তিনি সফল হবেন না।’
ওই দাবি নাকচ করে মাহজাবিন খালেদ গতকাল বলেন, ‘আমি মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফের মেয়ে। আমি নোংরা রাজনীতি করি না। নৌকার পক্ষে একজন কর্মী হিসেবে মাঠে কাজ করে যাচ্ছি। যিনি নৌকা পাবেন তাঁর পক্ষে কাজ করে যাব। আওয়ামী লীগ সভাপতি চাইলে আমাকে মনোনয়ন দেবেন। না চাইলে দেবেন না।’
নাটোরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কুদ্দুস এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রমজান আলী, স্থানীয় পৌরসভার মেয়র জলি চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার অবস্থান নিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বিপক্ষে। নেতাদের এই দ্বন্দ্বের কারণে জেলা আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত। এ দ্বন্দ্ব উপজেলা পর্যায়েও ছড়িয়ে পড়েছে। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্যই গতকাল দুই পক্ষকে ঢাকায় ডাকা হয়। ধানমণ্ডিতে সমঝোতা বৈঠকে দুই পক্ষের নেতাদের মিলমিশ করিয়ে দেন দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম শিমুল এমপি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে একটা দলাদলি ছিল। আজকের মিটিংয়ে একে অপরের হাত ধরিয়ে তা মিলমিশ করা হয়েছে।’ তিনি জানান, এখন থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ কোনো প্রগ্রাম করতে পারবে না। আহাদ আলী সরকারকে সংসদ সদস্য হিসেবে দেখতে চাই—এমন পোস্টার লাগানোর জন্য বৈঠকে তিরস্কার করা হয় বলেও জানান তিনি।
নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার বলেন, ‘নাটোরে এমপি শিমুলের মতো একজন মানুষের সামনে সাহস করে কেউ কথা বলতে পারে না। কিন্তু আমি সে কাজটা করেছি। নৌকা ও শেখ হাসিনার পক্ষে পোস্টার লাগিয়েছি।’ তিনি দাবি করেন, বৈঠকে পোস্টার নিয়ে কথা হয়েছে। তবে তাঁকে তিরস্কার করা হয়নি। এ বৈঠকে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
জানা যায়, বৈঠকে নাটোর জেলার দলীয় নেতাদের ঐক্যবদ্ধভাবে পথ চলতে বলা হয়েছে। একই কথা বলা হয়েছে জয়পুরহাট জেলার নেতাদেরও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ জেলায়ই বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ। গত ১৪ নভেম্বর ফরিদপুরের সালথায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে জিয়াউর রহমান নামে এক কর্মী নিহত হন। গত ৭ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া ইউনিয়নের বাখইলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বর্তমান চেয়ারম্যান কেরামতউল্লা ও সাবেক চেয়ারম্যান বখতিয়ার রহমানের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে আওয়ামী লীগের কর্মী বিল্লাল ও এনামুল নিহত হন। ১১ আগস্ট শরীয়তপুরের নড়িয়ায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হন যুবলীগ নেতা ইকবাল হোসেন। ১৮ জুলাই কুষ্টিয়ার মিরপুরে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে যুবলীগকর্মী শাহীন নিহত হন। এর আগে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে এমপির সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জের ধরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ফারুক সরদার নামে এক নেতা নিহত হন।
সারা দেশে আওয়ামী লীগের এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল আগামী নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ গতকাল বলেন, ‘অবশ্যই পড়বে। আমরা যদি কোন্দল নিরসন করতে না পারি, তাহলে সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ তবে দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসনের চেষ্টা চলছে বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি জানান, বর্তমান এমপিদের সঙ্গে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদেরই মূলত দ্বন্দ্বটা তীব্র।