বিতর্কিত আইসিটি আইন বিলুপ্ত করে প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারার বিরুদ্ধে জনমত ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। মানবাধিকার ও গণমাধ্যমকর্মীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারাও এই আইনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হচ্ছে এর তীব্র সমালোচনা। আইনটি জাতীয় সংসদে পাস করার আগে চূড়ান্ত খসড়াটির এই ধারাসহ বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি একটু ভেবেচিন্তে প্রণয়ন করা উচিত। কারণ, আইনটির চূড়ান্ত খসড়া মন্ত্রিপরিষদ সভায় অনুমোদন পাওয়ার পর বিভিন্ন মহল যেভাবে এর বিরোধিতা করছে, সরকারের উচিত তা বিবেচনায় নেওয়া। বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা নিয়ে যেভাবে সোচ্চার, তাঁদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এর আগে মনে হয় কোনো আইনে গণমাধ্যমের জন্য এত বিরোধাত্মক বিধান ছিল না। সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে খসড়াটি চূড়ান্ত করেছে, সেটি এখনো আইনের রূপ পায়নি। এখনো সুযোগ আছে খসড়াটি সংশোধন করার।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও একুশে টেলিভিশনের সিইও মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা প্রণয়নের সময় গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা এর বিরোধিতা করেছিলেন। সরকার বলেছিল, ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হবে না। শেষ পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হলো ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগের কথা, তার দ্বারা গণমাধ্যমকর্মীদের হয়রানির কথা।’ তিনি বলেন, ‘এখন নতুন করে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন করতে খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। সেই খসড়ার কোথাও সাংবাদিক বা গণমাধ্যম নিয়ে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু খসড়ার ৩২ ধারা নিয়ে শঙ্কার কথা বলছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। সরকার বলছে, এটির আপপ্রয়োগ হবে না। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা প্রণয়নের সময়ও একই কথা বলা হয়েছিল। তাই গণমাধ্যমকর্মীদের দাবি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, সম্পাদক ও সাংবাদিকতা বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের সঙ্গে পরামর্শ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়াটি আরো উপযোগী করা। সাংবাদিকরা এটি নিয়ে যে শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তার সমাধান না করে সংসদে আইন আকারে পাস করা হলে এটির অপপ্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করা সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা সাংবাদিকতার জন্য একটি উটকো ঝামেলা সৃষ্টি করবে। খসড়াটি সংশোধন না করে যদি আইন আকারে পাস হয়, তাহলে তা পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা করে তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া যাবে কি না তা নিয়েও আলোচনা করা হবে।’
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এবং মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তথ্য-প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওই আইন বাতিল করার জন্য এবার যা করা হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে এবং সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ আরো কঠিন হয়ে পড়বে।’ তিনি বলেন, “সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, ছবি তোলা, ভিডিও করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানে ‘বেআইনি’ শব্দটি ব্যবহার করে সাংবাদিকদের তথ্য-সংগ্রহ এবং ফটো বা ভিডিও চিত্র ধারণ বন্ধ করাই মূল উদ্দেশ্য। এ ধরনের কাজকে গুপ্তচরবৃত্তি বা রাষ্ট্রদ্রোহ বলে তথ্য সংগ্রহের কাজটি আরো কঠিন করে তোলা হলো। এটি সাংবাদিকতার জন্য চরম হুমকি।”
চূড়ান্ত খসড়া সংশোধনের দাবি টিআইবির : প্রস্তাবিত ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৭’কে জনগণের বাক ও মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক আখ্যায়িত করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এ আইনের সব বিতর্কিত ধারা সংশোধন এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনের অভিমতের ভিত্তিতে পরিমার্জনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই আহ্বান জানান।
কড়া সমালোচনায় সিপিবি : অবৈধ, অন্যায় ও গণবিরোধী কাজ করে পার পাওয়ার অভিসন্ধি থেকে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো ‘কালো আইন’ প্রণয়ন করতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। গতকাল পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে সিপিবি কার্যালয়ে ‘গণবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার কর’ শিরোনামে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারাকে ‘কালাকানুন’ আখ্যা দিয়ে সিপিবি সভাপতি বলেন, ওই আইনের কোথায় কোথায় সংশোধন করতে হবে সে বিষয়ে সুপারিশ ও পরামর্শগুলোর তোয়াক্কা না করে বিপরীতমুখী নতুন বিধান যুক্ত করে এবং বিচ্ছিন্ন ধারাগুলো এক জায়গায় করে আইন হচ্ছে। ‘কালাকানুন দূর হবে আশা করেছিলাম, কিন্তু সরকার কালো আইনের বদলে কুচকুচে কালো আইন জাতিকে উপহার দিচ্ছে।’