অনলাইন ডেস্ক: কতিপয় অসাধু শিক্ষক, জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং দালালদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ঘুষ-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট চিহ্নিত হয়েছে। এমপিওভুক্তিতে জড়িত এই সিন্ডিকেটভুক্ত ১১৭ জন কর্মকর্তা, শিক্ষক ও কর্মচারির তালিকা তৈরি করেছে সরকারের একটি তদন্ত সংস্থা। যথাযথ ব্যবস্থার সুপারিশসহ ওই প্রতিবেদনটি এখন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের টেবিলে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সম্প্রতি তালিকা করে ব্যবস্থা নিতে নামগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। একটি কপি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও দেয়া হয়েছে। তালিকা পেয়ে ইতিমধ্যে কয়েকজনকে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে বদলি করা হয়েছে। বাদবাকীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র এ খবর নিশ্চিত করেছে।
সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, এমপিওর কাজে এক একজন শিক্ষক বা কর্মচারীকে ন্যূনতম ৫ হাজার থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দেয়ার তথ্য। টাকা না দিলে হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব ক্ষেত্রে ঘুষ লেনদেন অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এমপিওভুক্তির কাজ মাঠ প্রশাসনে ছেড়ে দেয়ার পর এই ঘুষ বাণিজ্য রাতারাতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
শিক্ষকরা উৎকোচের শিকার হওয়ায় প্রকারান্তরে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা খাতে স্বচ্ছতা আনতে তদন্ত সংস্থাটি ৫ দফা সুপারিশ করেছে। চিহ্নিত ১১৭ জনের মধ্যে ৮৬ জন জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। ৬ জন বিভাগীয় উপপরিচালক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন দফতরের ১৬ জন কর্মচারীও আছে। সিন্ডিকেটে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার প্রধানরাও আছেন। তবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার এক মাস পর এখন পর্যন্ত ২৫ জনকে বদলি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তালিকা পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব জাভেদ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘এমপিওভুক্তিতে দুর্নীতি করার দায়ে কিছু কর্মকর্তার নামের একটি তালিকা আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পেয়েছি। তালিকাটি পর্যালোচনা করছি। অপরাধী কেউ রেহাই পাবে না। অপরাধ অনুযায়ী অভিযুক্তদের ক্লোজড, বদলি, ওএসডি, শোকজসহ নানারকমের ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সংস্থাটির প্রতিবেদনে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী এমপিও প্রার্থীর নাম-পরিচয় এবং প্রমাণ হিসেবে মোবাইল নম্বরও দেয়া হয়েছে। উল্লেখ আছে ঘুষের পরিমাণ। দাবিকৃত টাকা না দেয়ায় কতদিন ঘোরানো হয় ইত্যাদি বিষয়ও এতে বলা হয়েছে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। কিছু জায়গায় কে অভিযুক্ত তা অভিযোগকারীর পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি। সেসব ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির নাম তালিকায় উল্লেখ করা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট অফিস যে দুর্নীতিপ্রবণ সে বিষয়টি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, শিক্ষা খাতে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ নানা মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগের বড় কর্তাদের কাছে পৌঁছায়। কিন্তু তারা কারও বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা নেন না। গত ৯ বছরে বড় ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার তেমন নজির নেই। এক বছর আগে মাউশির কয়েকজন আঞ্চলিক পরিচালকের বিরুদ্ধে এমপিও-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ‘তিরস্কার’র মতো লঘুদণ্ড দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, কয়েক মাস পর সেই লঘুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনকে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়। শিক্ষা প্রশাসনে বদলিকে শাস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে কোনো বিষয়ে বড় ধরনের সমালোচনা উঠলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে বদলি ছাড়া অন্য কোনো ‘শাস্তি’ না দেয়ার রেওয়াজই চলে আসছে শিক্ষা প্রশাসনে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, ‘আমি এবারের (প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তালিকা ধরে) পদক্ষেপ নেয়ার আগে ঘোষণা করেছি, যে বা যারা তদবির করাবেন, তার বা তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো তালিকায় ১৮ জন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নাম আছে। এদের মধ্যে দু’জন আছেন যারা বর্তমানে পিআরএলে আছেন। একজন আছেন সাবেক ডিইও। এই তালিকায় আরও ৬৮ জনের নাম আছে। যাদের মধ্যে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা অফিসের পরিদর্শক, একাডেমিক সুপারভাইজার, প্রোগ্রামারসহ বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নামও আছে। এ তালিকায় রংপুরের একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ, গোপালগঞ্জের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং বরিশালের একটি মাদ্রাসার অধ্যক্ষের নাম আছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা অফিসের সিন্ডিকেটে বড় ভূমিকা পালন করেন সেখানের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, স্টেনো-টাইপিস্ট ও অফিস সহকারী, নৈশপ্রহরী পর্যায়ের কর্মচারীরা। কোথাও আবার একশ্রেণীর অসাধু অধ্যক্ষ ও প্রধান শিক্ষক এমনকি শিক্ষক নেতা এবং প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য দালালের ভূমিকা পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এমন ১৬ কর্মচারীর নামও উল্লেখ করা হয়েছে। তারা কোথায় কি করেছেন সে বিষয়েও উল্লেখ করা হয়েছে।