অনলাইন ডেস্ক: নেপালে বিধ্বস্ত ইউএস বাংলার ড্যাস-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজটি এর আগেও দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল। ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর একবার যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য উড়োজাহাজ রানওয়ে থেকে ছিটকে ঘাসের ওপর পড়ে। সেসময় যাত্রীরা ভয়ংকর আতঙ্কিত হলেও কর্তৃপক্ষ একটি ব্রিফ দিয়ে দায় সেরেছিল। এরপর থেকে উড়োজাহাজটি বারবার যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সিডিউল বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। তারপরও কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
জানা গেছে, ইউএস বাংলার ড্যাস-৮ কিউ ৪০০ এই উড়োজাহাজটি চলাচলের উপযোগী কোন ফিটনেস ছিল না। পানি পথে লঞ্চ যেমন ফিটনেস ছাড়া অহরহ চলছে, এবার আকাশ পথে উড়োজাহাজের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে। শুধু ইউএসবাংলা কর্তৃপক্ষ নয়, যারা ফিটনেস দেয় তারাও এর জন্য দায়ী। ফিটনেস পাওয়া নিয়ে বড় ধরনের দুর্নীতি। এক্ষেত্রে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতো মানুষের জীবন চলে যাওয়ার দায় এসব কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। গত রাতে সিভিল এভিয়েশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ফিটনেস পাওয়া নিয়ে এ ধরনের অভিযোগ তারাও শুনেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইউএসবাংলা এয়ারলাইন্স ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই প্রথমে যশোর-ঢাকা-যশোর রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। পরে পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার, সৈয়দপুর, রাজশাহী এবং বরিশালেও ফ্লাইট চালু করা হয়। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ এসব রুটে দৈনিক ৩২টি ফ্লাইট চলাচল করছে। এছাড়া ৭টি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রুটেও ফ্লাইট চালু করেছে এই এয়ারলাইন্স। রুটগুলো হচ্ছে- ঢাকা-মাস্কাট-ঢাকা, ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ঢাকা, ঢাকা-কুয়ালালামপুর-ঢাকা,ঢাকা-ব্যাংকক-ঢাকা, ঢাকা-কাঠমান্ডু-ঢাকা, ঢাকা-কলকাতা-ঢাকা এবং চট্টগ্রাম-কলকাতা-চট্টগ্রাম। ভবিষ্যতে তারা ঢাকা-গুয়াংজু-ঢাকা রুটে ফ্লাইট চালুর পরিকল্পনা করছে। এই এয়ারলাইন্সের নিজস্ব ৪টি ড্যাস-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ এবং ভাড়ায় আনা ৪টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ রয়েছে।
তবে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে সিডিউল বিপর্যয় প্রায়ই ঘটতো। ইদানিং ইউএসবাংলা এয়ারলাইন্সের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চলাচলে সিডিউল বিপর্যয় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। জানা যায়, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ড্যাস-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ ২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ৭৪ জন যাত্রী নিয়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানটি রানওয়ের এক প্রান্তে ইউটার্ন নিয়ে যখন পার্কিং বে-তে আসছিল তখন একটি চাকা আটকে যায়। সেদিন ঢাকা থেকে দ্রুততার সঙ্গে হেলিকপ্টারযোগে দক্ষ প্রকৌশলীদের নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রকৌশলীরা বিমানটি পার্কিং বে-তে ফিরিয়ে আনেন এবং ফিরতি যাত্রীদের নিয়ে যথারীতি ঢাকায় ফিরে আসে।
ঠিক প্রায় আড়াই বছর পর সেই উড়োজাহাজটি গতকাল নেপালে বিধ্বস্ত হল। ঢাকা থেকে নেপালের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বিমান সংস্থা ইউএস বাংলার ওই বিমানটি কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত হয়েছে। গতকাল সোমবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি খেলার মাঠে বিধ্বস্ত হয় উড়োজাহাজটি। এই দুর্ঘটনায় ২৭ বাংলাদেশীসহ ৪৯ যাত্রীর প্রাণহানি ঘটেছে।
জানা গেছে, ইউএসবাংলার উড়োজাহাজের কারিগরি ত্রুটি দীর্ঘদিন ধরে বাড়তি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাত্রী বোঝাই করে নির্ধারিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে উড়াল দেওয়ার পর আকাশেও উড়োজাহাজে মাঝে মাঝে কারিগরি ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। অনেক সময় বিমানবন্দরের র্যাম্প থেকে যাত্রীদের উঠিয়ে ট্যাক্সিওয়ে কিংবা রানওয়েতে গিয়ে কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ায় পাইলট ফ্লাইট টেকঅপ (উড়াল) করার সিদ্ধান্ত পরিহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এক্ষেত্রে যাত্রীদের নামিয়ে টার্মিনালে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরে ওই উড়োজাহাজের ত্রুটি দূর করে কিংবা অন্য কোন উড়োজাহাজে সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের পাঠানো হচ্ছে।
গত ৫ মার্চ ঢাকা থেকে সৈয়দপুরের উদ্দেশ্যে ইউএসবাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটটি ছাড়ার সময়সূচি ছিল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিট। যাত্রীদের ফ্লাইটে তোলা হয়। ফ্লাইটটি র্যাম্প থেকে ট্যাক্সিওয়ে পার হওয়ার পর রানওয়ের কাছাকাছি গেলে কারিগরি ত্রুটি দেখা দেয়। এ সময় পাইলট যাত্রা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন। সব যাত্রীকে টার্মিনালে ফেরত আনা হয়। এরপর অন্য একটি উড়োজাহাজে করে যাত্রীদের সৈয়দপুরে পাঠানো হয়। ৪ মার্চ সকালে প্রায় দুই ঘণ্টা বিলম্বে ঢাকা থেকে যশোরের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া একটি ফ্লাইটও যাত্রী নিয়ে আকাশে কারিগরি ত্রুটির কবলে পড়ে। ফ্লাইটটি মাঝ পথ থেকে আবার ঢাকায় ফিরে আসে। ফলে বিলম্বের কারণে উভয় দিকের যাত্রীদের বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়।
এই মডেলের বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়
নেপালে ইউএস বাংলার যে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে সেটি কানাডার বোম্বাডিয়ার কোম্পানির তৈরি ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ মডেলের। আকাশপথে বিশ্বের বিভিন্ন রুটে এই উড়োজাহাজ চলাচল করে। তবে এই মডেলের বিমানের বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই বিমান দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছে। নেপালে বিধ্বস্ত ইউএস বাংলার বিমানটি ১৬ বছরের পুরাতন। ১৯৮২ সালে ৯ মে ইয়েমেনের এডেনের কাছেই এই মডেলের একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাগরে পড়ে যায় বিমানটি। এতে ২১ যাত্রী ও ২ ক্রু প্রাণ হারান। এর ছয় বছর পর নরওয়েতে আবারও ড্যাশ সেভেন মডেলের বিমান দুর্ঘটনা কবলিত হয়। এতে ৩৬ জন আরোহীর সবাই নিহত হন।
বোমবার্ডিয়ার ড্যাশ-৮ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটে ১৯৮৭ সালে। সে বছরের ১৯ জুন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে যাওয়ার পথে ইঞ্জিন বিস্ফোরিত হয় বিমানটির। আগুন লেগে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। তবে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল যাত্রী ও ক্রুদের। গুরুতর আহত হয়েছিলেন চারজন। এক বছর বছরপরই আবারও দুর্ঘটনায় পড়ে এই মডেলের বিমান। যাত্রাপথ এবারও একই। হাইড্রলিক সিস্টেমে আগুন ধরে যায়। সৌভাগ্যবশত সেবারও যাত্রীরা বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হয়েছিলেন চারজন। এরপর ১৯৯০ সালে ব্যাংকক এয়ারওয়েজের একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে। ব্যাংকক থেকে থাইল্যান্ড যাচ্ছিল বোমবার্ডিয়ার ড্যাশ এইট মডেলের বিমানটি। তবে ভারী বর্ষণের এলাকায় গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন পাইলট। এরপর একটি নারিকেল গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয় বিমানটি। নিহত হন ৩৩ জন যাত্রী ও পাঁচজন ক্রু।
১৯৯৩ সালের ৬ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসে ড্যাশ-৮ বিমান বিধ্বস্ত হয়। জার্মানির ব্রিমেন বিমান বন্দর থেকে বিমানটি ১৯ যাত্রী নিয়ে আসছিল। বিমানে চারজন ক্রু ছিলেন। প্যারিস বিমানবন্দরে অবতরণের সময় রানওয়ে পরিবর্তন করতে বলা হলে পাইলট তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এতে চার ক্রু গুরুতর আহত হন। ১৯ যাত্রীর মধ্যে চারজন নিহত হন। ১৯৯৫ সালের ৯ জুন নিউজিল্যান্ডে ড্যাশ-৮ এর আরও একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়। খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। বিমানটিতে তিনজন ক্রু এবং ১৮ জন যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনায় একজন ক্রু ও চারজন যাত্রী মারা যান। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের বাফেলোর কাছাকাছি ড্যাশ-৮ বিমান বিধ্বস্ত হয়। বাফেলো বিমানবন্দর থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে একটি বাড়ির ওপরে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। এতে বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং বিমানটিও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিমানে থাকা ৪৫ যাত্রী ও চার ক্রু নিহত হন।