রং-পার্কিংয়ের পর কাগজপত্র না দেখিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়িয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) পরিচয়ে ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তাকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিবের বিরুদ্ধে। ওই উপসচিব শ্রম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হকের একান্ত সচিব। তবে ট্রাফিক পুলিশকে ভয়ভীতি দেখানোর কথা অস্বীকার করেছেন তিনি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের পরিদর্শক তারিকুল আলম সুমন বৃহস্পতিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এবিষয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। স্ট্যাটাসের সঙ্গে রয়েছে দুটি ভিডিও এবং দুটি স্থিরচিত্র। তার স্ট্যাটাসটি শনিবার (২১ এপ্রিল) রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সাত হাজার ২১৯টি শেয়ার হয়েছে।
স্ট্যাটাসে তারিকুল ইসলাম সুমন লিখেছেন, ‘‘একটু আগের ঘটনা। বাচ্চাকে স্কুল থেকে পিক করার জন্য ৭/৮ নম্বর গেটের কাছে আসলাম। দেখি প্রচণ্ড জ্যাম। কারণ, গাড়িওয়ালারা তিন লাইনে পার্ক করে, রাস্তা বন্ধ করে বসে আছে। আর উনাদের বাচ্চারা স্কুল গেটে কিছু খাচ্ছে, অথবা স্কুলেই খেলায় মত্ত। এদিকে, আমার মতো রিকশার যাত্রীরা অনবরত ট্রাফিক পুলিশকে গালি দিতে থাকলো। মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে সিভিল ড্রেসে একাই তৃতীয় সারির ১০টি গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে সার্জেন্টকে কল দিয়ে নিয়ে আসলাম, মামলা করানোর জন্য। বিপত্তি বাধলো এক সচিব স্যারকে নিয়ে। উনি নিজেকে পিএম-এর পিএস বলে পরিচয় দিচ্ছেন,যদিও আমি তা যাচাই করে দেখিনি। উনি মামলা তো দূরের কথা,গাড়ির কাগজই দেবেন না, আমি যা পারলে করি। আমি উনাকে বারবার স্যার সম্বোধন করে বলি যে, উনাকে আমি ছাড়লে সবাইকে ছাড়তে হবে। নইলে বাকি নয়জনের কাছে পরকালে হলেও জবাবদিহি করতে হবে। তাই উনাকে ছেড়ে দিয়ে সেই পাপের দায়ভার নিতে পারবো না। উনি আমার ওপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে যাবেন এই অবস্হা। আমিও নাছোড়বান্দা। বললাম, আমার লাশ পড়লেও আপনাকে মামলা নিয়ে যেতে হবে। উনি খুব গরম দেখাচ্ছিলেন। তাই আমি পথচারীকে ভিডিও করতে বলি, উনার গরম তখন পালালো। আমি ৯০০ টাকা জরিমানা করলাম। উনি আমার নাম জানতে চাইলে আমি এক ডিগ্রি এগিয়ে নিজের ভিজিটিং কার্ড দিয়ে, সালাম দিয়ে বললাম, Sir,you can transfer me anywhere of Bangladesh. আমি রাস্তার কামলা, কামলাই থেকে যাবো, বেতন একটাকাও কমবে না। আপনি যদি ভদ্রভাবে পরিচয় দিয়ে বলতেন, ‘আমি পিএম এর পিএস, আজকের মতো আমাদের সবাইকে ছেড়ে দেন, আর কোনোদিন এভাবে গাড়ি রাখবো না।’ আমি আপনাকেসহ সবাইকে সসম্মানে ছেড়ে দিতাম। কিন্তু আপনি ক্ষমতা দেখিয়ে শুধু আপনারটাই ছাড়াতে চাচ্ছেন, অন্য কারোটা নয়। অথচ আপনারা সবাই একই অপরাধে অপরাধী। বাকি সবাইকেও ৯০০ টাকা করেই জরিমানা করেছি। এবার মনে হয়, ঢাকার বাইরে পোস্টিংটা খুব দ্রুতই হবে!’’
টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) -এর এমন সাহসী কাজের প্রশংসা করে অনেকেই তার স্ট্যাটাসের নিচে কমেন্টস করেছেন। বানিউল আলম নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘প্রতিবাদ হোক এরকম আইনের ভাষায়। চালিয়ে যাও বন্ধু দেশের আইন ও মানুষের শুভকামনা আছে তোমার প্রতি।’
মোহাম্মদ আবু সালেহ নামে একজন লিখেছেন, ‘Well done, Bondhu! দু’চারজন মেরুদণ্ডি আছে বলেই এখনও সমাজে ভারসাম্য আছে। আইন মানার সংস্কৃতি আমাদের যেদিন চালু হবে, সেদিন এ সমস্যা আর থাকবে না। ভারতে একবার ইন্ধিরা গান্ধীর গাড়ি অবৈধ পার্কিংয়ের জন্য এক পুলিশ অফিসার (নামটা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। খুব সম্ভবত কিরণ রাও) ওখান থেকে সরিয়ে দেন এবং মামলা করে দেন। ইন্ধিরা গান্ধী তাকে কোনও শাস্তি তো দেননি বরং তাকে প্রমোশন দিয়েছিলেন। আমাদের দেশে এরকম কিছু দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন করতে পারলে, বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর থাকবে না।’
টিআই-কে (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) অনেকেই স্যালুট জানিয়েছেন। তাকে প্রশংসায় ভাসিয়েছে পুলিশের অনেক সদস্যও।
ভিডিওতে দেখা যায়, ওয়াকিটকি হাতে সিভিলে থাকা একব্যক্তির সঙ্গে গাড়িতে বসা অন্য একব্যক্তির তর্ক হচ্ছে। এসময় গাড়িটির সামনে এক স্কুলছাত্রী ও এক নারী দাঁড়ানো ছিল।
সিভিলে থাকা ব্যক্তিই টিআই তারিকুল আলম সুমন বলে নিজেকে দাবি করেছেন। তিনি পশ্চিম মগবাজার এলাকার পাশাপাশি বেইলি রোড এলাকায়ও দায়িত্ব পালন করেন। তবে ঘটনার সময় তার গায়ে পুলিশের ইউনিফর্ম ছিল না। যদিও তিনি দাবি করেছেন, ঘটনার সময় কর্তব্যরত সার্জেন্টকে তিনি ডেকে নিয়েছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে তারিকুল আলম সুমনের সঙ্গে কথা হয় । তিনি বলেন, ‘আমি এই এলাকার দায়িত্ব পালন করি। প্রতিদিনই এখানে রং-পার্কিং করে রাস্তায় যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা করা হয়। মানুষ যেতে পারে না। কিন্তু একটু সচেতন হলে এটা এড়ানো যায়। বেইলি রোড একটি ব্যস্ত সড়ক। কিন্তু মানুষের দুর্ভোগের কথা কেউ ভাবে না। আমরা চেষ্টা করি। সেখানেও সবার সহযোগিতা পাই না। সড়কের ওপর তিন সারিতে যখন গাড়ি পার্কিং দেখলাম, আমি দ্রুত সড়ক ক্লিয়ার করার জন্য চেষ্টা শুরু করি। কয়েকটি গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাই। তারা সবাই কাগজ পত্র দেয়। কিন্তু একটি গাড়ির চালকের কাছে কাগজপত্র চাইলে চালক আমাকে তার স্যারের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। আমি তখন তার মালিককে বললাম— কাগজপত্র দেওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দেন। আমি তখন তাকে স্যার স্যার করে সম্বোধন করে বিষয়টি বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারপরও তিনি কাগজপত্র দেবেন না। আসলে তার গাড়িতে কোনও কাগজপত্রই নেই। তখন আমি বললাম, আপনার গাড়ি ছাড়লে সবার গাড়ি ছাড়তে হবে। এরপর আমি তাৎক্ষণিক গাড়ির নম্বর লিখে দুটি মামলা দেই। একটি রং-পার্কিং অন্যটি সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায়। ৯০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এরপর জরিমানা আদায় করে গাড়িটি ছাড়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘এরপরও তিনি তার সত্য পরিচয় দেননি। গাড়ির নম্বর তল্লাশি করে দেখতে পাই, গাড়িটি ব্যক্তিগত। মালিকের নাম অমর চান বনিক। আমি চালকের নম্বরে ফোন দিয়ে তার পরিচয় জানতে পারি। যিনি প্রধানমন্ত্রীর পিএস পরিচয় দিয়েছিলেন, তিনি একজন উপসচিব, বর্তমানে শ্রমমন্ত্রণালয়ে রয়েছেন। পরে চালকের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি— তিনি কোনও একসময় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কাজ করতেন। সেই পরিচয় দিয়েছিলেন।’
টিআই তারিকুল আলম সুমন বলেন, ‘উপসচিবের গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ ৩১- ৫৭১৩। আমি পরে খোঁজ করে দেখলাম, গাড়িটির ফিটনেস মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল। এটি ফিটনেস সনদ ছাড়াই বর্তমানে চলছে।’
উপসচিব অমর চান বনিক বর্তমানে শ্রমপ্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হকের একান্ত সচিব। ট্রাফিক পরিদর্শকের সঙ্গে সেদিনকার তর্কাতর্কির বিষয়টি স্বীকার করেন তিনি। তবে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছি— শ্রম প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব। সে যদি প্রধানমন্ত্রীর পিএস শোনে, তাহলে আমার কী করার আছে? আমাদের কাছে গাড়ির কাগপত্র চেয়েছিল। চালককে সে মামলা দিয়েছে, বিষয়টি সেখানেই শেষ।’
গাড়ির ফিটনেস সনদ দুবছর ধরে না থাকার পরও চালাচ্ছেন, টিআইয়ের এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ফিটনেস মেয়াদ আছে, আগামী ২৬ এপ্রিল শেষ হবে। এটা একটু ঠিক করতে হবে।’
উল্লেখ্য, ভিডিওটিতে নারী ও শিশু থাকায় সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী সেটি প্রকাশ করা হয়নি।