রাজনীতির সংবাদ: ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনে শেষ হলেও কমিটি ঘোষণা হয়নি। কাউন্সিল অধিবেশনে ছাত্রলীগের গঠনতান্ত্রিক সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনার ওপর নেতৃত্ব বাছাইয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। ওই সময় দুই-একদিনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নতুন কমিটি ঘোষণা করবেন বলা হলেও দুই সপ্তাহ পেরিয়ে তা ঘোষিত হয়নি। কমিটি গঠনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর সতর্কতা অবলম্বনই এই বিলম্বের কারণ। কমিটির প্রস্তাবিত প্রতিটি নেতা সম্পর্কে গোয়েন্দা প্রতিবেদন বিশ্লেষণের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর নিয়েছেন শেখ হাসিনা।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিচ্ছন্ন ইমেজ ও ব্যাকগ্রাউন্ডের নেতাদেরই ছাত্রলীগের কমিটিতে স্থান দিতে চান প্রধানমন্ত্রী। এরই মধ্যে ব্যাপক যাচাই-বাছাইয়ের পর কমিটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদে পছন্দের প্রাথীদের নামও চূড়ান্ত করেছেন তিনি। ছাত্রলীগের নেতা কর্মীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে যে কোনো সময় নতুন কমিটির ঘোষণা আসতে পারে বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী একটি সূত্র।
সূত্র জানায়, কেবল কেন্দ্রীয় কমিটি নয়, সারাদেশের ছাত্রলীগে ব্যাপক সংস্কার আনতে চান শেখ হাসিনা। তাই কেন্দ্রীয় কমিটির পদ প্রত্যাশী নেতাদের পাশাপাশি সারাদেশের সব জেলা কমিটির বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছেন তিনি। কেন্দ্রের মতো অনেক জেলা ইউনিটেই অনুপ্রবেশকারী, চাঁদাবাজ, মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের নেতা বনে যাওয়ার অভিযোগকে ব্যাপক গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রধান। তার নির্দেশে কেন্দ্রীয় কমিটির পদ প্রত্যাশীদের পাশাপাশি জেলা কমিটি ও অন্যান্য ইউনিটের ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যাকগ্রাউন্ডও রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সর্বত্র সংস্কার আনতে চান তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, অধিকতর যোগ্য প্রার্থীকে খুঁজে বের কারতেই তিনি ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে সময় নিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সব কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও কমিটির পদপ্রত্যাশীদের ডাটা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। ছাত্রলীগ নিয়ে তিনি এবার অন্য কারও ওপর আর ভরসা রাখতেও চাচ্ছেন না। কারণ সামনে জাতীয় নির্বাচন, এতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে হবে। সার্বিক দিক চিন্তা করেই নেতৃত্ব বাছাইয়ের কাজটি প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছেন তিনি। ভারত সফর শেষে ফিরে কমিটি ঘোষণা করতে পারেন তিনি।
সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান সাংগঠনিক পদে নেতা নির্বাচন ছাড়াও ঢাকা বিশবিদ্যালয় ও ঢাকা মহানগরের আংশিক কমিটি করে দিতে পারেন তিনি নিজেই। এছাড়া ঢাকা ও এর আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটেও যোগ্য ও দক্ষ ছাত্রনেতাদের নেতার নাম দিয়ে দিতে পারেন নতুন নির্বাচিত সভাপতি-সম্পাদকের কাছে। তারা পরবর্তীতে এসব ইউনিটে কমিটি গঠন করবেন। মেয়াদপূর্তি না হলেও সাংগঠনিক গুরুত্ব বিবেচনায় অনেক জেলায় আসতে পারে নতুন কমিটি।
ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে পদপ্রত্যাশীদের যাচাইবাছাইয়ে সম্পৃক্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় একনেতা বলেন, প্রায় সপ্তাহখানেক আগেই আমরা যাচাইবাছাই শেষে ক্লিন ইমেজের সাতজন ছাত্রনেতার নামের তালিকা প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছি। এদের থেকেই প্রধানমন্ত্রী যোগ্যদের বেছে নিবেন। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণায় বিলম্ব করার মূল কারণ হলো, ছাত্রলীগে যেন আর অনুপ্রবেশকারী না ঢোকে। ছাত্রলীগকে কেউ যেন বিপথে নিয়ে যেতে না পারে।
কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে প্রধানমন্ত্রী বয়সসীমা ২৮ বছরের মধ্যে রাখার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দি্চ্ছেন। পাশাপাশি তিনি দুটি খতিয়ে দেখছেন। প্রথমত, সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আছে কি না, অভিযোগগুলো অদৌ সত্য কি না। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা কার ব্যাপারে কত উৎসাহী? বেশ ক’জন নেতা আছেন যারা তাদের পছন্দের ছেলেমেয়েদের কমিটিতে রাখতে চান। ওই কমিটি যেন নিজেদের পকেট কমিটি হিসেবে কাজ করে। এসব বিবেচনায় ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে এবার আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সব সিন্ডিকেট অকার্যকর করতে চান। ছাত্রলীগের দুই-তিনজন শীর্ষনেতার গতিবিধি নজরদারিতে রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ছাত্রলীগের কমিটি বিলম্ব হওয়ার কারণ ছাত্রলীগকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত নানামুখী সমস্যার পর্যবেক্ষণ ও নীরিক্ষণ শেষে তার সুষ্ঠু সমাধান বের করা। বিভিন্ন জেলায় শীর্ষ পদে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী। ঢাকা মহানগরের কয়েকটি কলেজ শাখা ছাত্রলীগের শীর্ষ পদধারী মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ঢাকার একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকও এ তালিকায়। এসব বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলকে। এজন্য দলের নেতারা এর সমাধানের পুরো দায়িত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। রাষ্ট্রীয় ও দলীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি আপাতত যেটুকু সময় বের করতে পারেন তখনই ছাত্রলীগের বিভিন্ন বিষয়ে সমাধান খোঁজেন শেখ হাসিনা।
সূত্র জানায়, ছাত্রলীগ নেতাদের কার্যক্রমের কয়েকটি ভয়াবহ চিত্র ও তথ্য-উপাত্ত গোয়েন্দারা প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্রলীগকে পরিকল্পিতভাবে জঙ্গি সংগঠনে পরিণত করার টার্গেট ছিল অনুপ্রবেশকারীদের। ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদের পাশাপাশি সারাদেশের বিভিন্ন জেলা ইউনিটে শিবির, ছাত্রদল, শান্তি কমিটির সন্তান-স্বজনসহ স্বাধীনতাবিরোধী মতাদর্শের ছাত্রদের ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি অওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে আলোচনাকালে বলেছেন, ‘ছাত্রলীগকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে সেটা হতে দেবো না।’
জানা গেছে, ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচনে পদ প্রত্যাশী সবাইকে প্রধানমন্ত্রী ডেকে কথা বলবেন না। তবে যাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে বসাবেন সেই ২৫-৩০ জনের সঙ্গে তিনি কথা বলতে পারেন। তাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা ও কর্মপন্থা বলে দিবেন।
সর্বশেষ মন্ত্রিসভার বৈঠকে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে বিলম্বের বিষয়ে আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলে জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি ৩২৩ জন পদ প্রত্যাশীর অতীত, পারিবারিক পরিচয়সহ জীবনবৃত্তান্ত এবং সাংগঠনিক ও গোয়েন্দা সংস্থার ৫ স্তরের রিপোর্ট মিলিয়ে দেখছেন। এজন্য সময় লাগছে।
সূত্রমতে, বিগত দুটি কমিটির প্রথম সারির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জমা পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। দেশ-বিদেশে তাদের জাঁকজমকপূর্ণ রাজসিক জীবনযাপনে আয়ের উৎস খোঁজা হচ্ছে। অনেকের আন্তর্জাতিক কানেকশন রয়েছে। এসব বিষয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শীর্ষ মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর এ কারণেই কেন্দ্রীয় কমিটর প্রধান সাংগঠনিক পদ নেতা নির্বাচন চূড়ান্ত হওয়ার পরও কমিটি ঘোষণার আগে নিবিড় পর্যবেক্ষণ চলছে।