ন্যাশনাল ডেস্ক: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান ও তদন্ত নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। সর্বোচ্চ আদালতও দুদক কর্মকর্তাদের তদন্তে ব্যর্থতা ও গাফিলতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ নিজেই ক’দিন আগে কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও একাগ্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, রাজনৈতিক চাপ ছাড়াও নানামুখী বাধা-বিপত্তির মুখে তাদের কাজ করতে হয়। এ কারণেও তদন্ত ব্যাহত হয়।
দুদকের অনুসন্ধান প্রক্রিয়া নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলছেন তাদের অনেকের অভিমত, পৃথিবীর কোনও দেশে মামলার আগে অনুসন্ধান করার কোনও দৃষ্টান্ত নেই। এটাও সময়ক্ষেপণ ও অপরাধীকে সুযোগ করে দেওয়ার নামান্তর।
দুদকের যেকোনও মামলার তদন্ত ছয় মাসের মধ্যে (১৮০ দিন) শেষ করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বেসিক ব্যাংকের সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ কেলেঙ্কারির ৫৬ মামলার তদন্ত আড়াই বছরেও শেষ হয়নি। এ নিয়ে সর্বশেষ বুধবার (৩০ মে) উচ্চ আদালতে এসব মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন বিচারকরা। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের ও দুদক আইনজীবীর বক্তব্য শুনে হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ বলেছেন, ‘আপনাদের কথা শুনে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’ দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের বক্তব্যের মধ্যেই আদালত তাকে বলেন, ‘চার্জশিট দিচ্ছেন না কেন? এ ধরনের মামলায় আড়াই বছর লেগে গেল? তাহলে কেমনে হবে?’
গত ১৯ এপ্রিল দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে দুদকের মামলার পলাতক আসামিদের পরিসংখ্যান দেখে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুদকের মামলার অনেক আসামিই আদালতে আত্মসমর্পণ না করে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কীভাবে মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে? তাদের সাজা নিশ্চিত করতে না পারার জন্য তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়ী করে তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ, অনুসন্ধান, তদন্ত ও প্রসিকিউশনে কর্মকর্তাদের নৈপুণ্য, দক্ষতা এবং একাগ্রতার অভাবেই আসামিরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে দুদক কর্মকর্তাদের কাজ করতে হয়। বিশেষ করে যারা মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত করেন তাদের ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক চাপ তো আছেই। পৃথিবীর কোনও দেশে মামলার আগে অনুসন্ধানের দৃষ্টান্ত নেই। এতে দুদক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে পারেন। দুর্নীতিবাজরাও সুযোগ নিতে পারেন। অনুসন্ধানের নামে তাদের কি পার পাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে না? অনুসন্ধান ও তদন্তে গাফিলতি ও অদক্ষতার বিষয়টিও একেবারে অমূলক নয়।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব সামসুল আরেফিন অনুসন্ধান ও তদন্ত নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি কাছে। কমিশনের মহাপরিচালক (অনুসন্ধান ও তদন্ত) মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কথা বলার কোনও এখতিয়ার নাই। জনসংযোগ কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলবেন।’ কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত নিয়ে কথা বলার কিছু নাই।’
অনুসন্ধান ও তদন্তে গাফিলতি কিংবা ব্যর্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে উচ্চ আদালতে নিয়োজিত দুদকের মামলার আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘এখানে আমি কোনও ব্যর্থতা কিংবা গাফিলতির কিছু দেখি না। মামলা তদন্তের সময় অনেক ধরনের তথ্য-উপাত্ত ও ডকুমেন্টস সংগ্রহ করতে হয়। সেজন্য অনেক ক্ষেত্রে সময় বেশি লাগতেই পারে।’ বুধবার আদালতের প্রশ্নের জবাবেও দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আমরা তো চেষ্টা করছি। আদালতের প্রত্যেকটা আদেশের পর প্রত্যেক তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে বসেছি। তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনও গাফিলতি নেই। তারপরও কোনও দুর্বলতা আছে কিনা আমরা দেখবো।’
দুদক সূত্রে জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশন তার সামগ্রিক কার্যক্রম ছয়টি অনুবিভাগের মাধ্যমে পরিচালনা করে। অনুসন্ধান ও তদন্ত তার একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুবিভাগ। এই অনুবিভাগের অধীনে অনুসন্ধান ও তদন্ত-১ এবং অনুসন্ধান ও তদন্ত-২ নামে দুটি শাখা রয়েছে। দুটি শাখার মাধ্যমে অনুবিভাগের আওতাধীন ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশালের ছয়টি বিভাগীয় কার্যালয় ও ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। দুর্নীতির অপরাধগুলোর বিচারকাজ প্রধানত নির্ভর করে অনুসন্ধানের ওপর।
দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ১৯ ও ২০ ধারায় অনুসন্ধান ও তদন্ত সম্পর্কে দুদককে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। দুদকের সংশ্লিষ্ট শাখার হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে তিন হাজার ৭৫৯টি অভিযোগের অনুসন্ধানের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। এরমধ্যে এক হাজার ৪৪৫টি অভিযোগের অনুসন্ধান শেষ করা হয়। অনুসন্ধান শেষে ২৭৩টি মামলা দায়ের করা হয়। নিষ্পত্তি করে দেওয়া হয় এক হাজার ২৪৬টি। ২০১৭ সালের শুরুতে দুদকের হাতে দুই হাজার ৯৫টি মামলার তদন্ত কার্যক্রম বাকি (পেন্ডিং) ছিল। এরমধ্যে ওই বছর তদন্ত শেষ করা হয় ৯৬৫টি মামলার তদন্ত। আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয় ৩৮২টি মামলার। চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেওয়া হয় ৩১৯টি মামলার। ২৬৪টি মামলার নিষ্পত্তি করা হয় অন্যান্যভাবে।