জি.এম আবুল হোসাইন : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়নের ১৫টি সোস্যালাইজেশন সেন্টারে প্রতিনিয়তই খেলাধুলা, লেখাপড়া আর বিনোদনে মেতে ওঠে স্থানীয় শিশুরা।
সেভ দ্য চিলড্রেন’র সহযোগীতায় ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’র বাস্তবায়নে সদর উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে কুশখালি, বৈকারি, ঝাউডাঙ্গা, ফিংড়ি ও ভোমরা ইউনিয়নে “গুড কজ ক্যাম্পেইন” প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এসব ইউনিয়নে ১৫টি সোস্যালাইজেশন সেন্টারের অধীনে ২০টি শিশু ক্লাব গঠন করা হয়েছে। এই ক্লাব গুলোতে কর্মএলাকার ৫৩১২ জন শিশুকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
সরেজমিনে কুশখালী ইউনিয়নের পলাশ শিশু কেন্দ্র পরিদর্শনে গেলে কেন্দ্রের কমিউনিটি মোবিলাইজার আবুল হোসেন জানান, কেন্দ্রটি এসব এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সের এসব শিশুদের খেলাধুলা, লেখাপড়া আর বিনোদনের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হয়েছে। এই কেন্দ্র গ্রামের শিশুদের মাঝে দ্যূতি ছড়াচ্ছে। এই কেন্দ্রে রয়েছে শিশুদের জন্য খেলাধুলার নানা সরঞ্জাম। লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে সেখানে সকাল বিকাল শিশুরা এসে হৈ হুল্লোড়ে মেতে ওঠে। উন্মুক্ত মাঠে খেলাধুলা করে। সমাজের ভালোমন্দ দিক সম্পর্কে নিজেরা অবগত হয়। শিশুরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বরদের কাছে যেয়ে নিজেদের অধিকারের বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করে থাকে।
কথা হয় ১০ বছরের শিশু আসমার সাথে। আসমা খাতুনের মা সালমা খাতুন গাজিপুরের একটি ইটভাটায় কাজ করতে যায় প্রায় ২বছর আগে। সাথে নিয়ে যায় শিশু আসমা (১২).কে। তাকেও ইটভাটার ঝুকিপূর্ণ কাজে বাধ্য করা হয়। এর পাশাপাশি অন্যের বাড়ির গৃহস্থলির কাজও করা লাগে। সেখানে তাকে মারধর করা হতো। সেখান থেকে সে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স ও ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তায় বাড়ি ফিরে এসেছে। অনিরাপদ অভিবাসন থেকে ফিরে এসেছে আসমা খাতুনই এখন অনেক পাল্টে গাছে। সে এখন ভাদড়া স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আসমার প্রতিবাদের মুখে তারই এক প্রতিবেশি বোনের বাল্য বিবাহ বন্ধ হয়েছে বলে সে জানায়।
শুধু আসমা নয়, কথা হয় পলাশ শিশু কেন্দ্রের সদস্য আতিক ইকবাল, ওসমান গনি, তুহিন হোসেন, রোকাইয়া সুলতানা, তন্বী খাতুন, সাথী খাতুন, আসমা খাতুন, ইয়াসাতুর রিয়াদ, জাহিদ হোসেন ও ফাতেমা খাতুনের সাথে। এখন ওরা নিয়মিত স্কুলে যায়, ক্লাস থেকে ঝরে পড়া দুরের কথা নিজেদের অধিকার আদায়ে বড়দের সাথে কথা বলে। পাচারের কবল থেকে নিজেদের রক্ষায় তারা এখন জোরালোভাবে সোচ্চার।
তারা চেয়ারম্যানের কাছ থেকে রাস্তা সংস্কার, এলাকার পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে সহযোগিতা লাভ করেছে। ছোট ছোট শিশুরা যাতে পাচার না হয়, কোনো বখাটে যুবক যাতে তাদের উত্ত্যক্ত করতে না পারে, কোনো ধরনের হয়রানি বা অনৈতিকতার মুখে না পড়ে, তারা যাতে অনিরাপদ অভিবাসনের শিকার না হয় সে জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে বলতে পারছে।
আমি খেলি, আমি শিখি অনিরাপদ স্থানান্তর থেকে নিরাপদ থাকি। শিখবে শিশু হেসে খেলে শাস্তিমুক্ত পরিবেশ পেলে এই সব স্লোগানে মুখরিত এসব কেন্দ্র।
কুশখালী ইউনিয়নের সমাজ ভিত্তিক শিশু সুরক্ষা কমিটির সভাপতি মোছা. মনজুরা খানম ইতি বলেন, শিশুরা যাতে কোনো ধরনের সন্ত্রাস মাদক ও জঙ্গিবাদের মতো অপরাধের সাথে জড়িত না হয় সে জন্য আমরা সচেতনতার সৃষ্টি করছি। অতি দরিদ্র শিশুদের জন্য প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। তাদের খেলাধুলার সুযোগ সৃষ্টি করেছি। স্থানীয় অভিভাবক দলের সদস্য মো. রকিব উদ্দিন বাবলু বলেন, শিশুরা যাতে পাচারের শিকার না হয় তারও ব্যবস্থা করেছি আমরা। তারা যাতে বাল্য বিয়ের শিকার না হয় সেদিকেও নজর রয়েছে আমাদের। সব মিলিয়ে তাদের সুরক্ষায় কাজ করছি আমরা।
শিশুরা জানায় তাদেরকে দেশে বিদেশে ভালো কাজ কিংবা অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রলোভন দেখায় সমাজের দুষ্ট প্রকৃতির কিছু অর্থলোভী মানুষ। আমরা দুষ্ট প্রকৃতির এসব অর্থলোভী মানুষের প্রতারণা ও হয়রানী থেকে বাঁচতে বিভিন্ন তথ্য ও নির্দেশনা দিয়ে থাকি।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ঝুঁকিপূর্ন পাঁচটি ইউনিয়ন আমরা বেছে নিয়েছি। এগুলি হচ্ছে কুশখালি, বৈকারি, ঝাউডাঙ্গা, ফিংড়ি ও ভোমরা। আমরা জানতে পেরেছি এই এলাকাগুলোতে বেশি শিশুরা অনিরাপদ স্থানান্তর হয়ে থাকে। তাদের বাবা-মায়ের সাথে দেশের বিভিন্ন জেলা ও পার্শবর্তী দেশ ভারতে কাজ করতে যাওয়ার সময় শিশুকেও সাথে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে। সেই শিশু জানেনা তাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখান থেকে তারা অনেক কিছু শিখতে, জানতে পারছে। এখানে এসে লাইব্রেরীতে বই পড়ে, খেলাধুলা করে, ফেলানো জিনিস দিয়ে তারা অনেক ভালো ভালো শো-পিচ তৈরী করে।
ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সে’র সাতক্ষীরা প্রকল্প অফিসের ইনচার্জ মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, শিশুদের খেলাধুলার জন্য চাহিদা মত মাঠ নেই। তাদের স্কুলগুলির শৌচাগারও ব্যবহার উপযোগী নয়। তাদের বাবা মা যথেষ্ট সচেতন না হওয়ায় লেখাপড়া ফেলে তাদেরকে শিশুদের শ্রমে বিনিয়োগ করে। দারিদ্র্যের কারণে অনেক শিশু দেশের অভ্যন্তরে এমনকি দেশের বাইরেও পাচার হয়। তারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। মাদকের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। সীমান্ত এলাকা হওয়ায় শিশুরা চোরাচালানের মতো অপরাধেও পা বাড়ায়। এসব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা থেকে তাদের সুরক্ষা দিতে ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স কাজ করছে। শুধুমাত্র শিশুদের সচেতন করাই নয়, তাদের অভিভাবক বিশেষ করে মায়েদের নিয়ে মাঝে মধ্যে বৈঠক করছে।