বিদেশের খবর: মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের হত্যা-ধর্ষণসহ বর্বর নিধনযজ্ঞের জন্য দায়ীদের জাতিসংঘের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে চান দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচ দেশের ১৩২ জন আইনপ্রণেতা। এ জন্য তারা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
শুক্রবার (২৪ আগস্ট) এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে দেশটির সরকার এবং দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর চাপ বাড়াতে হবে।
২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সঙ্কটের এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগের দিন শুক্রবার আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ানস ফর হিউম্যান রাইটসের (এপিএইচআর) ওয়েবসাইটে ওই যৌথ বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর ও পূর্ব তিমুরের আইনপ্রণেতারা রয়েছেন। তাদের মধ্যে ২২ জন এপিএইচআর সদস্য।
বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমার রোম সংবিধিতে স্বাক্ষরকারী দেশ না হওয়ায় রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় দেশটিকে বিচারের মুখোমুখি করার এখতিয়ার হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) নেই। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদই পারে আইসিসির মাধ্যমে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরুর ব্যবস্থা করতে।
এপিএইচআরের বর্তমান চেয়ার মালয়েশিয়ার আইনপ্রণেতা চার্লস সান্তিয়াগো বিবৃতিতে বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করার পর এক বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু ওই ঘটনায় দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করার কোনো লক্ষণ আমরা এখন পর্যন্ত দেখিনি।’
‘মিয়ানমার যেহেতু বিষয়টির তদন্ত করতে অনিচ্ছুক এবং অপারগতা প্রকাশ করছে, তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই এ ঘটনায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসতে হবে। মিয়ানমারে যারাই ওই ভয়ঙ্কর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকুক না কেন, তাদের অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। তাদের ছেড়ে দিয়ে ভবিষ্যতে আবারও একই ধরনের বর্বরতা ঘটানোর সুযোগ আমরা দিতে পারি না।’
আসিয়ানের ১৩১ জন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে মিয়ানমারের অপরাধের বিষয়টি যত দ্রুত সম্ভব আইসিসিতে পাঠাতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিবৃতিদাতা আইনপ্রণেতারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক জোট আসিয়ানকেও এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। এছাড়া আসিয়ানের সদস্য দেশ ইন্দোনেশিয়া আগামী বছর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যোগ দিচ্ছে অস্থায়ী সদস্য হিসেবে।
ইন্দোনেশিয়া এবং আসিয়ান যাতে মিয়ানমার সরকার ও দেশটির সেনাবাহিনীর ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করে- সে আহ্বানও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।
এছাড়া বিবৃতিদাতা এমপিরা জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংগি লি যাতে মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্ত করার সুযোগ পান, সেজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনও চেয়েছেন।
গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বৃহদাকারে দমন-পীড়ন শুরু করে। তারা নির্বিচারে রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণ ও পুরুষদের হত্যা করে বলে অভিযোগ ওঠে। আর প্রাণে বাঁচতে এ পর্যন্ত আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা পালিয়ে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে।
তবে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বলে আসছে, তাদের লড়াই ‘সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে, কোনো জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল করতে নয়।
সম্প্রতি দেশটির ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি সিঙ্গাপুরে এক বক্তৃতাকালে রোহিঙ্গা ফেরানোর দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়ে বলেন, তার দেশ শুধু ‘পালিয়ে যাওয়াদের’ গ্রহণ করতে পারে। তাদের ফেরানোর দায়িত্ব বাংলাদেশের।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্কীকার করে না। এমনকি দেশটির কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহারেও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। সু চি তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেননি। দেশটি রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী বলে স্বীকারই করে না। যদিও সু চির পিতা জেনারেল অং সানের সরকারে চারজনে রোহিঙ্গা মন্ত্রী আরাকান তথা রাখাইনের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
১৩২ এমপির বিবৃতিতে আরো বলা হয়, মিয়ানমারে সুবিচারের অভাব কেবল রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নয়, দেশটির কাচিন ও শান প্রদেশে অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ওপরও প্রভাব ফেলছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের কারণে এ প্রদেশগুলিতেও হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।