অপ্রত্রিম: না, কোনও রূপকথা নয়। কোনও মেগা সিরিয়াল-সোপ অপেরা অথবা প্যাকেজ নাটক কিংবা পরাবাস্তব সিনেমার কল্পিত দৃশ্যকাব্য অথবা জাদুবাস্তবতার নিরিখে লেখা উপন্যাসও নয়। এটি একটি বাস্তব ঘটনা, ৪ বছর বয়সী ছোট বোনকে বাঁচাতে গিয়ে ৮ বছর বয়সী বোন একরকম আত্মাহুতিই দিয়েছে।
ইতালির ভূমিকম্পে নিহত মানুষদের সারিবদ্ধ কফিনের মধ্যে থাকা এক বাক্সে বন্দি হয়ে রয়েছে স্বজনের জন্য আত্মাহুতির চিরায়ত মানবিক বোধের সেই গল্প। রয়েছে জীবনের জয়ী হওয়ার এক আখ্যান। সেই গল্প তুলে এনেছেন ভূমিকম্প বিধ্বস্ত দেশটিতে উদ্ধারকর্মে অংশ নেওয়া মানুষেরা।
গত ২৩ আগস্ট (মঙ্গলবার) ভূমিকম্পে প্রাণ হারানো প্রায় ৩শ’ মানুষের শোক নিয়ে শনিবার ৩৫ জনের গণ-শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। আসকোলি পিচেনো শহরের একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্সে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় নিহতদের কফিন। এই কফিনগুলোর মধ্যে দুইটি সাদা বাক্সে ভয়াবহ ভূমিকম্পে নিহত শিশুদের দেহ রাখা আছে। একটি কফিনে চিরতরে ঘুমিয়েছেন এক আট বছরের শিশু জিউলিয়া রিনালদো। ছোট বোন জর্জিয়াকে বাঁচাতে গিয়েই নাকি সে নিজে মরেছে!
উদ্ধারকর্মীদের বিশ্বাস, জিউলিয়ার তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তেই বেঁচে যায় জর্জিয়া। সে নিজেকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বোনকে বাঁচাতে চেয়েছে। জিউলিয়ার কফিনের ওপর একটি ছোট নোট লিখে দিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা। তারা লিখেছেন, ‘শোন, ছোট্ট সোনা, আমরা তোমাকে ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কি দুর্ভাগ্য, সময়মতো সেখানে পৌঁছাতে পারিনি।’
নোটটি লিখেছেন আন্দ্রিয়া নামের এক উদ্ধারকর্মী, যিনি জিউলিয়ার দেহ ও জর্জিয়াকে উদ্ধারের সময় সেখানে ছিলেন। আন্দ্রিয়া আরও লেখেন, ‘আমরা দুঃখিত, তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমাকে বাঁচানোর জন্য যা যা প্রয়োজন সবই আমরা করেছি। আমি যখন বাড়ি ফিরেছি, তখনও জানি, উপর থেকে এক দেবদূত আমাকে দেখছে। জিউলিয়া, যদিও আমি তোমাকে চিনতাম না, কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
পিসকারা দেল ত্রন্তো গ্রামের বাসিন্দা ছিলো ওই দুই ছোট্ট মেয়ে। দুর্যোগের পর যখন উদ্ধারকারী দল সেখানে পৌঁছায়, ততক্ষণে কেটে গেছে ১৬ ঘণ্টা। শিকারী কুকুররা শুঁকে শুঁকে বের করে জর্জিয়ার অবস্থান। মেয়েটি ভেঙ্গেচুরে যাওয়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপের তলায় ১৬ ঘণ্টা ধরে মৃত বড় বোনের কোলের মধ্যে বেঁচে ছিল।
শনিবার, জিউলিয়ার শেষকৃত্যের দিন ছিল জর্জিয়ার জন্মদিন, পাঁচ বছরে পড়লো সে।
শেষকৃত্য সম্পাদনকারী বিশপ জিওভানি ডি’ইরকোল বলেন, ‘বড় বোনটি ছোট বোনকে বাঁচাতে চেয়েছিল। ছোট বোনকে পাওয়া গেছে ভীতসন্ত্রস্ত, পুরো মুখে ধুলো মাখা। যেন জীবন ও মৃত্যুর আলিঙ্গনে। তারপরও জীবনের জয় হয়েছে। কেননা, ভূমিকম্পের পর বেঁচে যাওয়া পুনর্জন্ম পাওয়ার মতোই সৌভাগ্যের বিষয়।’
উদ্ধারের পর থেকে জর্জিয়া এখনও কোন কথা বলেনি। তার ওপর দিয়ে যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে গেছে, তার আঘাত এখনও সামলে উঠতে পারেনি পাঁচ বছরে পা দেওয়া ছোট্ট মেয়েটি। তবে কেবল বিশপ নন, অনেকেই এই ঘটনাকে বড় বোনের আত্মাহুতিতে ছোট বোনের পুনর্জন্মের মতো করেই দেখছেন।