রাজনীতির খবর: দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একান্তে পেয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা প্রাণ খুলে কথা বললেন। কেউ তুলে ধরলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বহুবিধ অভিযোগ। কেউ শোনালেন রাজনীতি করতে গিয়ে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হওয়ার বর্ণনা। কেউ বা জানালেন দলে নিজের অবদানের নানা তথ্য। সঙ্গে সঙ্গে দলীয় সভাপতির উত্তরও মিলল। শেখ হাসিনা কাউকে কঠিন, কাউকে কোমল ভাষায় দলীয় অবস্থান বোঝালেন। বুধবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের ব্যাংকোয়েট হলে ক্ষমতাসীন দলের দুই শতাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীকে ডাকেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাঁদের মনোবেদনার নানা কথা শোনেন।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কাছে বেশ কয়েক দিন ধরেই বহুবিধ অভিযোগ জানিয়ে আসছিলেন বিপুলসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী। ফলে তাঁদের কথা সরাসরি যাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জানতে পারেন, সে উদ্যোগ নেওয়া হয়। বুধবার রাতে দুই শতাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী হাজির হন গণভবনের ব্যাংকোয়েট হলে। তবে কোনো কোনো আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজে উপস্থিত না থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিজের পক্ষে বক্তব্য দিতে গণভবনে পাঠান। মঞ্চে বসেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
সূত্রগুলো জানায়, উপস্থিত নেতাদের মধ্য থেকে অর্ধশতাধিক নেতা বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পান। কথা বলার সময় কেউ কেউ কেঁদে ফেললে আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ মহাজোটের সমীকরণে শরিকদের আসন ছেড়ে দেওয়ায় নিজেদের বঞ্চিত ও নির্যাতিত হওয়ার কথা তুলে ধরেন। কেউ কেউ নিজ দলীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে নানা অন্যায় ও জুলুম-নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ধরেন।
বক্তব্য দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ঢাকা মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কোহিনূর বেগম। তিনি বলেন, ‘আমাদের আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। একদিকে এলাকায় উন্নয়ন হয়নি, অন্যদিকে আমরা বিভিন্ন সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছি। আমরা চাই এই আসনে নৌকার প্রার্থী দেওয়া হোক’।
কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রুহুল আমিন অভিযোগ এনে বলেন, ‘ঢাকা-৪ আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা আমাদের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করেছেন। আমাদের নেতাকর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছে। আমরা চাই এখানে দলীয় প্রার্থী দেওয়া হোক।’ এ সময়ে শেখ হাসিনা জানতে চান, ‘ওখানে বিএনপির কে নির্বাচন করবে?’ উত্তরে একজন বলেন, ‘সালাউদ্দিন।’ আরেকজন জানান, ২০০৮-এর নির্বাচনে সানজিদা খানম ৪৮ হাজারের বেশি ভোটে বিএনপির প্রার্থীকে পরাজিত করেছিলেন।
চাঁদপুরের একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী দলীয় সংসদ সদস্য ডা. দীপু মনির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরে বলেন, চাঁদপুরের চরে নৌকা আটকে গেছে। তখন শেখ হাসিনা জানতে চান, ‘কেন?’ উত্তরে ওই মনোনয়নপ্রত্যাশী বলেন, এমপির দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে। উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দীপু মনির বিরুদ্ধে তো দুর্নীতির অভিযোগ নাই।’
বৈঠকে উপস্থিত একজন নেতা জানান, নাটোরের একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী নাটোর-২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। তখন শেখ হাসিনা জানতে চান, ‘ওখানে বিএনপির কে নির্বাচন করবে?’ উত্তরে মনোনয়নপ্রত্যাশী ওই নেতা বলেন, ‘দুলু’। তখন শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনাদের মনে নাই? আগে তো আহাদ আলী সরকারকে দিয়েছিলাম। তার পরিবারের স্ত্রী, ছেলে কী করেছে?’
মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে মহাজোটের সমীকরণে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ার আলোচনা চলছে। ওই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছাত্রলীগের সাবেক নেতা গোলাম সারোয়ার কবীর বলেন, ‘নেত্রী আমাদের আসনে জনপ্রিয় প্রতীক বা জনপ্রিয় প্রার্থী দিন। যেকোনো একটা হলে জয়লাভ সহজ হয়। আমরা অনেকেই এমপি হতে চাই। তবে আপনার প্রধানমন্ত্রী হওয়া বেশি জরুরি। যাকে মনোনয়ন দিলে আপনি প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটাই আপনি করুন।’ জবাবে শেখ হাসিনা হেসে বলেন, ‘তুমি তো ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কথা বললা। একদিকে জোটের বিরুদ্ধে বললা, আবার অন্যদিকে বললা আমি প্রধানমন্ত্রী হই এটা চাও।
নেত্রকোনা সদর আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ভিপি লিটন বলেন, ‘২০০১-এর নির্বাচনের পর আমার দুইটা পা ভেঙে দেওয়া হয়। প্রায় দেড় বছর চিকিৎসার পর পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারি। আপনি ক্ষমতায় না এলে আমাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়ত।’
নীলফামারী-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সরদার ফারহানা আখতার সুমী বলেন, ‘নেত্রী, আপনি আমাদের যেভাবে তৈরি করেছেন তাতে আমরা এখন যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রস্তুত। আমার এলাকায় এমনভাবে কাজ করেছি যে এখানে বিএনপির চেয়ারপারসন দাঁড়ালেও আমি জয়লাভ করব।’ তরুণ নেত্রীর এমন বক্তব্যে শেখ হাসিনা হাততালি দেন। অন্যরাও হাততালি দেয়। শেখ হাসিনা জানতে চান, ‘তোমার নাম কী?’ উত্তরে সুমী তাঁর নাম বলার পর শেখ হাসিনা উপস্থিত নেতাদের বলেন, ‘দেখছ কী আত্মবিশ্বাস!’
সূত্রগুলো জানায়, নড়াইলের সংসদ সদস্য কবিরুল হক মুক্তিকে মনোনয়ন না দিতে স্থানীয় একজন নেতা বক্তব্য দেন। তবে অন্য একজন নেতা মুক্তির পক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। নরসিংদী-৩ আসনের সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম মোল্লার বিরুদ্ধেও বক্তব্য দেন একজন নেতা। এ ছাড়া পাবনা, বরিশাল, বরগুনা, নরসিংদী ও ঢাকার একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী তাঁদের বক্তব্যে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে ধরেন।
সূত্রগুলো জানায়, দীর্ঘদিন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে আলাপকালে শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনে জয়লাভের ওপর গুরুত্ব দেন। শেখ হাসিনা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কড়া নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘তোমরা যদি গ্রুপিং কর, তাহলে তোমাদের আমি দেখব না। সবাই একসঙ্গে কাজ করে নৌকাকে বিজয়ী করতে হবে। নৌকা জিতলে আমরা সরকার গঠন করব। তখন তোমাদের আমি দেখতে পারব। দল ক্ষমতায় আনাই এখন তোমাদের মূল টার্গেট।’
এদিকে গতকালও গণভবনে সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে কথা বলেন শেখ হাসিনা। এ সময় অনেক নেতা নানা অভিযোগ তুলে ধরেন। তবে অনেকে দলের অন্য নেতাদের নামে বিষোদগার শুরু করায় শেখ হাসিনা বিরক্ত হয়ে একপর্যায়ে প্রত্যেক জেলা থেকে একজনকে বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেন। খুলনা বিভাগের এক নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন সময় সাক্ষাত্ করতে চেয়ে পাননি বলে জানান। এ কথা শুনে শেখ হাসিনা তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের সতর্ক করে দেন এবং পরে ওই নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দেন।