দেশের খবর: নাটোরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে এক নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে যৌন হয়রানি, কর্মচারীকে বেদম মারধর এবং সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন কাজে অসহযোগিতা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী নারী ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযোগ, ডিসি তাঁকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কুপ্রস্তাব ও রাতে সার্কিট হাউসে যাওয়ার জন্য চাপ দেন।
কুপ্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় তাঁকে দাপ্তরিকভাবে হয়রানি করেন। এর প্রতিকার চেয়ে ওই ম্যাজিস্ট্রেট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া আর্ট কলেজের আরেক ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব এবং নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সদ্য যোগদানকারী জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমান।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মাত্র আড়াই মাস আগে চলতি বছরের ৯ সেপ্টেম্বর নাটোরের জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন গোলামুর রহমান। ২০তম বিসিএস ব্যাচের এই ক্যাডার অফিসার সর্বশেষ কর্মরত ছিলেন শিপিং করপোরেশনের ম্যানেজার হিসেবে। সম্প্রতি জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। তবে যোগদানের পর থেকেই সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন কাজে তাঁর অসহযোগিতা ও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে অল্প সময়েই ক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ ও বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এর মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ওঠে নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে যৌন হয়রানির।
সূত্র জানায়, ডিসি গোলামুর রহমান ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁর কার্যালয়ের ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে সম্প্রতি ফেসবুক মেসেঞ্জার এবং মোবাইল ফোনে কুপ্রস্তাব দেন। এ অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ডিসি বিভিন্নভাবে ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে হয়রানি করেন। পরে ভুক্তভোগী ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেট লিখিতভাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি অবগত করেন। এর ফলে মন্ত্রণালয় তাঁকে অন্যত্র বদলি করে। তবে মান-সম্মানের ভয়ে ওই নারী ম্যাজিস্ট্রেট গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। শুধু নারী ম্যাজিস্ট্রেট নন, ডিসি গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে বগুড়া আর্ট কলেজের এক ছাত্রীকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে কুপ্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ৭ নভেম্বর নাটোর শহরের কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠের পাশে পুরনো ডিসি বাংলো পরিদর্শনে যান জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমান। এ সময় ডিসি বাংলোর দেখভালের দায়িত্বে থাকা ডিসি অফিসের মাস্টাররোলের কর্মচারী মোতালেব হোসেন গেটের চাবি আনতে দেরি করায় শারীরিকভাবে তাঁকে মারধর করেন ডিসি। এ ছাড়া কর্মচারী মোতালেবসহ দুজনকে চাকরিচ্যুত করে বাংলো থেকে বের করে দেওয়ার নির্দেশ দেন ডিসি। এ নিয়ে কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
এ বিষয়ে মাস্টাররোলের কর্মচারী মোতালেব হোসেন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার আসতে দেরি হওয়ায় ডিসি স্যার আমাকে মেরেছেন। ’ এ সময় নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মচারী বলেন, ‘আমার ৩০ বছরের চাকরিজীবনে এত খারাপ ডিসি কখনো দেখিনি। তিনি যোগদানের পর থেকে পুরো ডিসি অফিসে হ-য-ব-র-ল অবস্থা বিরাজ করছে। তাঁর ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস পায় না। অবিলম্বে এ ধরনের ডিসির বদলির দাবি জানাচ্ছি। ’
সরকারি দপ্তরের বিভিন্ন কাজে অসহযোগিতার বিষয়ে জানা যায়, গত ১৬ নভেম্বর নাটোর সুগার মিলস এবং নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন করলেও আখের চিনি সাদা করার জন্য প্রয়োজনীয় সালফার আনার অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দিচ্ছেন না ডিসি গোলামুর রহমান। নাটোর সুগার মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ শহিদুল্লাহ বলেন, ‘বর্তমান জেলা প্রশাসকের কোনো সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি না। সালফার আনার অনুমতির জন্য ১৫ দিন ধরে তাঁর কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি করলেও তিনি অনুমতি দেননি। সালফারের অভাবে মিলটি যেকোনো দিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ’
অন্যদিকে গত ৭ নভেম্বর কান্দিভিটা এলাকায় নাটোরের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী পুরনো পার্ক ভেঙে লেডিস ক্লাব করেছেন বর্তমান জেলা প্রশাসক। এ বিষয়ে নাটোরের লেখক-সাহিত্যিক, আইনজীবী ও সাংবাদিকরা শিশু পার্কটি চালু কারার দাবিতে স্মারকলিপি দিলেও আজ পর্যন্ত তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। এ নিয়ে স্থানীয় নাগরিক সমাজের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদার বলেন, ‘প্রাচীন এই শিশু পার্কটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নাটোরবাসীর আবেগ। কিন্তু হঠাৎ করে শিশু পার্কটি বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা ক্ষুব্ধ। ’
সচেতন নাগরিক কমিটি নাটোর জেলা শাখার সভাপতি রনেন রায় বলেন, একজন জেলা প্রশাসক হিসেবে গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ মেনে নেওয়া যায় না। অবিলম্বে তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
অভিযোগের বিষয়ে জেলা প্রশাসক গোলামুর রহমান বলেন, কখনো কখনো তাঁর ফেসবুক আইডি হ্যাক করা হয়। কেউ হ্যাক করে এ কাজগুলো করে থাকতে পারে। ফেসবুক আইডি হ্যাক হলেও আপনি আইনগত ব্যবস্থা নেননি কেন—প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চলে। তবে আমি ফেসবুকের বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে চাই না। ’ এ ছাড়া কোনো কর্মচারীকে মারধরের ঘটনা ঘটেনি বলে তিনি দাবি করেন।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, ডিসি গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে ধরে ছয় দফার একটি গোপন প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠিয়েছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। ওই প্রতিবেদনে আসন্ন নির্বাচনে তাঁর দায়িত্ব পালনেও সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়।
এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব শেখ ইউসুফ হারুন অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। ভুক্তভোগী প্রতিকার চাইলে এই বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’