ন্যাশনাল ডেস্ক: ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮, ২০১৪ এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি—দেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনেই জয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীনেরা ।
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে চার মাসের ব্যবধানে দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু দুটি নির্বাচনের ফলাফল ছিল দুই রকম। ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’র কারণে বিরোধী দলহীন যে নির্বাচনটি করেছিল সেটিতে তারা ‘নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ অর্জন করলেও ১২ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পরের নির্বাচনটিতে হারই সঙ্গী হয়েছিল বিএনপির।
বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই জয়ী হয়েছে ক্ষমতাসীনেরা। ১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮—বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চিত্রই এক।
১৯৯০ সালের শেষে এক গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের সংক্ষিপ্ততম সময়ের জন্য গঠিত সংসদেই পাস হয়েছিল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান। এরপর ১৯৯৬, ২০০১ আর ২০০৮ সালে তিনটি নির্বাচন এভাবেই হয়েছে। আর এই তিন নির্বাচনে ফল পুরোপুরি গেছে সর্বশেষ ক্ষমতায় থাকা দলটির বিরুদ্ধে। পরে আওয়ামী লীগ শাসনামলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলই জয়ী হয়।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের মানুষের এক নতুন অভিজ্ঞতা। মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন দলে দলে, সেখানে কোনো বাধা ছাড়াই তাঁরা ভোট দিচ্ছেন, কোথাও কোনো সংঘাত নেই, সংঘর্ষ নেই, চারদিকে উৎসবের আবহ—স্বাধীনতার পর এই দৃশ্য কখনোই দেখা যায়নি। নির্বাচন বলতে এর আগে মানুষের অভিজ্ঞতা ছিল শক্তিশালী প্রার্থীর সমর্থকদের সন্ত্রাস আর জাল ভোটসহ নানা ধরনের অনিয়মের সাক্ষী হওয়া। একানব্বইয়ের নির্বাচন ছিল পুরোপুরিই অন্য রকম। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’, এই বাক্যের প্রয়োগ প্রথমবারের মতোই সেবার অনুভব করেছিলেন বাংলাদেশের ভোটাররা।
ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের শাসনামলে অনুষ্ঠিত ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনামলের ১৯৭৯ সালের নির্বাচন ছিল পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক। নিবন্ধিত প্রায় সব রাজনৈতিক দলই দেশের ইতিহাসের প্রথম দুটি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল একটু ব্যতিক্রম। আপাতদৃষ্টিতে অংশগ্রহণমূলক হলেও এতে বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। যদিও আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিলেও ১৯৮৮-তে বয়কট করে।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন দেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অবস্থান ছিল খুব শক্ত। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটি সে সময় বিরাট বিজয় পাবে, এটাই ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। সেবার ২৮৯ আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর দেখা যায় আওয়ামী লীগ ২৮২টি আসন লাভ করেছে। বিরোধী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন বাকি ৭টি আসন। বিরোধী রাজনৈতিক দল সে নির্বাচনে মাত্র দুটি আসন লাভ করে, যার একটি পান জাতীয় লীগের বর্ষীয়ান নেতা আতাউর রহমান খান আর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) আবদুস সাত্তার।
অবশ্য ক্ষমতাসীনদের অধীনে নির্বাচনগুলো একেবারে বিতর্কমুক্ত ছিল না। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় প্রত্যাশিত ছিল। তবে প্রয়াত রাজনীতিবিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ের ১৪২ পৃষ্ঠায় ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন সম্পর্ক বলেছেন, ‘এ নির্বাচন সর্বাংশে শান্তিপূর্ণ ও অবাধ হয়েছিল, তা বলা যাবে না। কোনো কোনো আসনে বিরোধীদলীয় প্রার্থীকে বলপূর্বক পরাজিত করা হয়েছে বলে নির্বাচনের পর অভিযোগ আনা হয়।’
জিয়ার আমলে ১৯৭৯ সালের নির্বাচন নিয়ে মূল অভিযোগ হচ্ছে, এতে সরকারি দল বিএনপির প্রার্থীদের ব্যাপকভাবে প্রশাসনিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদান। এ ব্যাপারে মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর ‘রাজনীতির তিনকাল’ গ্রন্থের ১৯০ পৃষ্ঠায় ১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে বলেছেন, ‘নির্বাচনী ফল নিয়ে সে সময় দেশে তুমুল সমালোচনা শুরু হয়। নীলনকশা অনুযায়ী এমন নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন একটা সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দলের পক্ষে সম্ভব হয়েছে একটি মাত্র কারণে, সেটা হলো দলটির প্রধান দেশের রাষ্ট্রপতি নিজে এবং ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করা।’
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা-পরবর্তী সময়ে এমনিতেই আওয়ামী লীগ সে সময় ছিল অনেকটাই দিগ্ভ্রান্ত, অভিভাবকহীন। নির্বাচনের আগে দলে বিভক্তি দেখা দেয়। ‘আওয়ামী লীগ’ নাম নিয়েই আরও একটি দল নিবন্ধিত হয়। তারাও নির্বাচনে অংশ নেয় এবং দুটি আসন লাভ করে। মূল আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৯টি আসন। ২০৭টি আসন নিয়ে ‘সরকারি দল’ বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও ১৯৭৯-এর সংসদ নির্বাচনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ৮টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ৮টি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ৫টি, আওয়ামী লীগ (মিজান) ২টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ১টি, জাতীয় গণফ্রন্ট ২টি, জাতীয় লীগ ২টি, জাতীয় একতা পার্টি ১টি ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন ১টি আসন লাভ করে। সে নির্বাচনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ১১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৮৬ সালে এরশাদের নির্বাচনটিও অনেকটা ১৯৭৯-র আদলে হয়েছিল। পূর্বসূরি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের মতোই এইচ এম এরশাদের উদ্দেশ্য ছিল, একটা নির্বাচন করে নিজের রাজনৈতিক উত্তরণ আর সামরিক শাসনের বৈধতা। সে লক্ষ্যেই ৭ মে দেশের তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরশাদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে ‘সরকারি দল’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। অনেক নাটকীয়তার পর এতে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) তিনটি অংশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ-মোজাফ্ফর), ওয়ার্কার্স পার্টি (নজরুল) প্রভৃতি দল। তবে ‘স্বৈরাচারের অধীনে’ বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছিল বিরোধী পক্ষের তরফ থেকে। বহু জায়গায় জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের পক্ষে কেন্দ্র দখল করে ব্যালট পেপারে সিল মারার অভিযোগ ওঠে। ‘মিডিয়া ক্যু’র মাধ্যমে রেডিও-টেলিভিশনে ফলাফল পাল্টে দেওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ ছিল আওয়ামী লীগের। এ নির্বাচনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩ আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামী লীগ পায় ৭৬ আসন। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী ১০টি, কমিউনিস্ট পার্টি ৬টি, মুসলিম লীগ ৪টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) ৩টি, ওয়ার্কার্স পার্টি (নজরুল) ৩টি আর ন্যাপ ২টি আসনে জয়লাভ করে। উল্লেখ্য, এই নির্বাচনে ৩০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে এসেছিলেন। এদের ২৮জন অবশ্য নির্বাচনের পরপরই সরকারি দল জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন।
ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ প্রথমে সংসদ অধিবেশনে অংশ নেয়নি। পরে অবশ্য তারা সংসদে যোগ দেয়। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতেই, এই নির্বাচনের অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগ থেকে বিরোধী রাজনীতিকদের মধ্যে একটা উপলব্ধির জন্ম দেয় যে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন পুরোপুরি অবাধ ও নিরপেক্ষ হতে পারে না।
ছিয়াশির সংসদ বেশি দিন টেকেনি। ১৯৮৭ সালের শেষ দিকে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সংসদ ভেঙে দেন। তোড়জোড় শুরু করেন চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের। কিন্তু এ নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রায় কেউই অংশ নেয়নি। ছিয়াশির নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়। রাজনীতিবিদ মিজানুর রহমান চৌধুরী তাঁর ‘রাজনীতির তিনকাল’ বইয়ে এ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো নিয়ে রীতিমতো কৌতুক করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো আগেই এ নির্বাচন বয়কট ও প্রতিরোধের কথা ঘোষণা করেছিল। ফলে দেখা গেল মাঠে জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কেউ নেই। এ অবস্থায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণের লক্ষ্যে নাম, সাইনবোর্ড ও প্যাডসর্বস্ব কিছু ‘পায়ে দল’, ‘হোন্ডা দল’কে বিরোধী দল আখ্যা দিয়ে আসন ছেড়ে দেওয়ার লক্ষ্যে নির্বাচনে নামতে রাজি করানো হয়।’
এই নির্বাচনে সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনার জন্ম দেন জাসদের একাংশের সভাপতি আ স ম আবদুর রব। তিনি ছোট ছোট দল নিয়ে একটা বিরাট রাজনৈতিক জোট গঠন করে ফেলেন। সেটির নাম দেওয়া হয় ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ বা ‘কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টি—কপ’। নির্বাচনে এই ‘কপ’ ১৯টি আসন পেয়েছিল। রব নির্বাচিত হয়েছিলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক রহমান ও আবদুর রশিদের ফ্রিডম পার্টিও সংসদে আসন লাভ করে।
জাতীয় পার্টি এ নির্বাচনে ২৫১টি আসন পায়। কপ ১৯টি আসন নিয়ে পরিণত হয় দ্বিতীয় বৃহত্তম দলে। শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন আরেকটি ‘জাসদ’ ৩টি আসন পায়। ফ্রিডম পার্টির আসনসংখ্যা ছিল ২টি। এ নির্বাচনে ২৫ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হন।
১৯৮৮-র নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘প্রহসন’ হয়েই আছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির অনুপস্থিতিতে কার্যত এতে সরকারি দল জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভোটাররা ভোট দিতে যাননি। ফলে ভোটারবিহীন এ নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থীরা নিজেরাই সন্ত্রাসের মাধ্যমে কেন্দ্র দখল করে ভোটের বাক্স ভর্তি করার মহড়া দিয়েছিলেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের কাছে ছিল ভিন্ন ধরনের এক অভিজ্ঞতা। স্বতঃস্ফূর্ত ও অংশগ্রহণমূলক সে নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করে বিএনপি। নির্বাচনে দলটি ১৪০ আসন পেলেও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিরঙ্কুশ ছিল না। সেবার জামায়াতে ইসলামীর ১৮ জন প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিএনপি জামায়াতের সেই ১৮ সংসদ সদস্যের সমর্থন নিয়েই গঠন করেছিল এরশাদ শাসন-পরবর্তী সরকার। নির্বাচনে ৮৮ আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল আওয়ামী লীগ। সদ্য বিদায়ী সরকারি দলে জাতীয় পার্টি পেয়েছিল ৩৫ আসন। এ ছাড়া বাকশাল ৫টি, সিপিবি ৫টি আসন লাভ করে। ন্যাপ (মোজাফ্ফর), জাসদ (সিরাজ), এনডিপি, গণতন্ত্রী পার্টি লাভ করে ১টি করে আসন। সেবার ৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটেছে বলা হলেও বিএনপি সরকারের আমলে নির্বাচনী সংস্কৃতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ১৯৯৩ সালের দিকে মাগুরা ও মিরপুরে দুটি উপনির্বাচনে সেটি প্রমাণিত হয়। আসন দুটিতে সরকারি দল বিএনপির বিজয় মোটামুটি নিশ্চিত থাকলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। এর পরপরই আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মতো বিরোধী দলগুলো সংবিধানে স্থায়ীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের দাবি তোলে এবং ইস্যুটি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৯১-১৯৯৬ সালের বিএনপি সরকার অবশ্য সে দাবি মানেনি। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তৈরি হয় অনিশ্চয়তা। বিএনপি সরকার মরিয়া হয়ে ওঠে নিজেদের অধীনে নির্বাচন করানোর, বিরোধী দলগুলো দাবি করতে থাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের। এমনই একটা সময়ে ‘সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা’ রক্ষার জন্য ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ নির্বাচন বয়কট করে। ফলে এটি পরিণত হয়ে ১৯৮৮ নির্বাচনের মতোই আরও একটি ‘নামকাওয়াস্তে’ নির্বাচনে। বিএনপির প্রার্থীদের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। ’৮৮-এর নির্বাচনের মতোই এতে অংশ নেয় ফারুক-রশিদের ফ্রিডম পার্ট। ৪৮টি আসনে বিএনপির প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হন। ২টি আসনে ব্যাপক গোলযোগের কারণে নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়নি। ২৫০টি আসনে শেষ পর্যন্ত ভোটের এক ধরনের মহড়া হয়।
নির্দলীয় ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর দেশে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি ও জামায়াতের বয়কটের মুখে একতরফা নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়। তাদের দাবি ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন। ১৫৩টি আসনে সেবার কোনো নির্বাচনই হয়নি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মহাজোটের প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়ে যান। এ নির্বাচন দেশের ইতিহাসে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত আগের নির্বাচনগুলির মতোই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে।
এবারের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। এই নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ করছে বিরোধী জোট ও দলগুলো।
এবারের নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। যখন যে দলের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, তখন তারা নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের জন্য সাধারণ মানুষের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেনি। কেউ কেউ তো নিজেদের অধীনে নির্বাচনকে রীতিমতো প্রহসনে পরিণত করেছিল। তবে আমরা আস্থা রাখতে চাই এই সরকারের ওপর। বিশ্বাস রাখতে চাই।’