দেশের খবর: নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানের পর শপথ নেয়া থেকেও বিরত থাকল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাত নির্বাচিত সংসদ সদস্য। যাদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির পাঁচজন এবং গণফোরামের দুজন।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার পর জাতীয় সংসদ ভবনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও স্বতন্ত্রভাবে নবনির্বাচিত সদস্যরা শপথ নেন।
এদিকে জাতীয় সংসদ ভবনে যখন শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান চলছিল তখন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে ধানের শীষের প্রার্থীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতারা।
বৈঠক শেষে বিকালে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে ফলাফল বাতিলের দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি দেন ফ্রন্টের নেতারা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ স্মারকলিপি দেন তারা।
পরে মির্জা ফখরুল ইসলাম জানান, স্মারকলিপিতে তারা নির্বাচনের অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি অনিয়মের তথ্য-উপাত্তের পাঁচটি ফাইল জমা দিয়েছেন। আরও তথ্য-উপাত্ত কমিশনে জমা দেবেন। পাশাপাশি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলাও দায়ের করবেন। তিনি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচন করার দাবি জানান।
৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। নির্বাচনে মাত্র সাতটি আসনে জয়ী হয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
বিএনপির নির্বাচিত পাঁচ এমপি হলেন- মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (বগুড়া-৬ আসন), মোশারফ হোসেন (বগুড়া-৪), জাহিদুর রহমান (ঠাকুরগাঁও-৩), আমিনুল ইসলাম (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২) ও হারুনুর রশিদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩)। আর গণফোরামের দুই এমপি হলেন- সুলতান মোহাম্মদ মনসুর (মৌলভীবাজার-২) এবং মোকাব্বির খান (সিলেট-২)।
এ বিষয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করলে আবার শপথ থাকে নাকি? আমরা শপথ নিচ্ছি না।
বিকাল ৩টার পরপরই সিইসির রুমে যান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শীর্ষ নেতারা। তবে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন ইসিতে আসেননি। প্রায় আধ ঘণ্টার বৈঠকে তারা সিইসির কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। পরে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মুখপাত্র মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের এ স্মারকলিপি জমা দেয়াকে কেন্দ্র করে ইসিতে কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়। ইসির নিরাপত্তায় ছিল পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি ও ডগস্কোয়াড।
স্মারকলিপি জমা দেয়ার পর মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মাঠপর্যায়ের কোনো স্তরেই নিয়ন্ত্রণ ছিল না নির্বাচন কমিশনের, একজন কমিশনারের বক্তব্যে তা প্রমাণ হয়েছে। দীর্ঘ ১০ বছর ভোটাধিকারবঞ্চিত জনগণকে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে আবারও বঞ্চিত করার দায় নির্বাচন কমিশনকেই বহন করতে হবে।
নির্বাচনের অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ব্যালট পেপারের মুড়িতে ভোটারের সই বা টিপ সই লাগে। আপনারা দেখেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নেই। প্রতারণা, জালিয়াতির মাধ্যমে ভোটগ্রহণের দায় ইসিকেই বহন করতে হবে। কেননা, নির্বাচনের আগের রাতেই ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট কেটে ব্যালট বাক্সে ভরে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের আসতে বাধা দেওয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। নির্বাচনের আগের দিন ও রাতে পোলিং এজেন্ট এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নানারকম হুমকি দেয়া হয়, গ্রেফতার করা হয়। তাদেরকে এলাকা ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ক্ষেত্রে বিশেষে ভোটকেন্দ্রে আসলেও এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রায় সকল কেন্দ্রেই দুপুরের মধ্যে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যায়। পরে মধ্যাহ্ন বিরতির নামে ভোটকেন্দ্রের মূল ফটক বন্ধ করে দেয়া হয়। নজিরবিহীনভাবে বিচারিক ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। অনেক কেন্দ্রে ১০০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়, যা অবাস্তব। নির্বাচনে দলীয় ব্যক্তিদের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অনেক ভোটকেন্দ্রেই বিকাল ৪টার আগেই ভোটগণনা শুরু হয়। সারাদেশে জালভোটের মহোৎসব চললেও কোথাও একজন জালভোট প্রদানকারীকেও গ্রেফতার করা হয়নি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, নির্বাচন কমিশন এ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতির সঙ্গে মশকারি (উপহাস) করেছে। জাতিকে অন্ধকারে দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ জন্যই প্রত্যাখ্যান করেছি। এবং পুনর্নির্বাচনের জোর দাবি জানাচ্ছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শপথ নেয়ার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে। আমরা তো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে ইসি কী বলছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা শুধু স্মারকলিপি গ্রহণ করেছে। তাদের কোনো কথা নেইতো।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচন (দশম সংসদ নির্বাচন) বর্জন করেছিলাম, সেটাই সঠিক, তা প্রমাণ হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামীতে কি কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে তা পরে জানবেন।
স্মারকলিপিতে যেসব ক্যাটাগরিতে অভিযোগ করা হয়েছে সেগুলো হলো- তফসিল ঘোষণায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা) আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ভোটিং ও হয়রানি, দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অজ্ঞাত স্থান থেকে টেলিফোনে ভয় দেখানো, মনোনয়নপত্র বাছাই ও আপিলে রিটার্নিং কর্মকর্তা-ইসির রহস্যজনক ভূমিকা।
অভিযোগে আরও রয়েছে নেতাকর্মীদের গায়েবি মামলা ও হয়রানি, প্রার্থীদের গ্রেফতার ও আটক, দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিরুৎসাহিত করা, প্রচারে বাঁধা দেয়া, সাজানো প্রশাসন ও পুলিশের রদবদল না করা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেনাসদস্যদেরও নিষ্ক্রিয় করে রাখা। এ স্মারকলিপিতে ভোটের দিনের অনিয়মের ১৭ ধরনের অভিযোগ করা হয়।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, জেএসডি’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু, কার্যকরি সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত রায় চৌধুরী, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না প্রমুখ।