নিজস্ব প্রতিবেদক: দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) যেসব কর্মকর্তা জাহালমের বিরুদ্ধে মামলাগুলো তদন্ত করেছেন, যাঁদের কারণে একজন পাটকল শ্রমিক বিনা দোষে তিন বছর কারাগারে কাটিয়েছেন; সেসব তদন্ত কর্মকর্তার ভাগ্যে সম্প্রতি কমিশন থেকে পদোন্নতিও জুটেছে। ২৬টি মামলার ৯ তদন্ত কর্মকর্তার আটজনই সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে বিভিন্ন স্থানে বদলি ও দায়িত্ব পেয়েছেন। কাজের মূল্যায়ন করেই গত মাসে আরো অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁদের পদোন্নতি দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
যাঁদের কারণে একজন সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিক ব্যাংকে বহু লাখ টাকার জালিয়াতির মামলায় ফেঁসে যান, সেই কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিয়ে কমিশনের ভেতরেও কাউকে কাউকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। তবে দুদকের ওই তদন্ত কর্মকর্তারা ‘ব্যাংক কর্মকর্তাদের ভুলেই এমনটি হয়েছে এবং ব্যাংক কর্মকর্তারাই জাহালমকেই জালিয়াত হিসেবে চিহ্নিত করায় মামলায় তাঁর নামে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে’ বলে কাছে দাবি করেন।
দুদক সুত্রে জানা গেছে, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেকের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২৬টিতে জাহালমকে আসামি আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের এসব মামলায় জাহালম গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন। মামলাগুলো তদন্ত করেন দুদকের উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক, উপসহকারী পরিচালকসহ ৯ জন তদন্ত কর্মকর্তা।
জানা গেছে, ওই ৯ কর্মকর্তার মধ্যে সহকারী পরিচালক সেলিনা আক্তার মনি এখন পদোন্নতি পেয়ে উপপরিচালক হয়েছেন। মেফতা হুল জান্নাত উপসহকারী পরিচালক থেকে পদোন্নতি পেয়ে এখন সহকারী পরিচালক। মাসুদুর রহমান সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক হয়েছেন। আর উপসহকারী পরিচালক থেকে সহকারী পরিচালক হয়েছেন জয়নাল আবেদীন; সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক হয়েছেন রাফি মো. নাজমুস সাদাত; সহকারী পরিচালক থেকে উপপরিচালক হয়েছেন এ এস এম সাজ্জাদ হোসেন, উপসহকারী পরিচালক থেকে সহকারী পরিচালক হয়েছেন মো. সাইদুজ্জামান; উপসহকারী পরিচালক থেকে সহকারী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন সিলভিয়া ফেরদৌস। একজন তদন্ত কর্মকর্তা শেখ মেজবাহ উদ্দিন উপপরিচালক হিসেবেই মামলা তদন্ত করেছেন, এখনো তিনি সেই পদেই আছেন।
৯ কর্মকর্তার তদন্তেই জাহালমকে জালিয়াতির হোতা হিসেবে চিহ্নিত করে চার্জশিট দেওয়া হয়। ফলে সেসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিন বছর জেল খেটেছেন জাহালম। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশিত হলে দুদকের একজন কমিশনার গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি নিয়ে অধিকতর তদন্তের নির্দেশনা দেন। পরে ওই ৯ কর্মকর্তাই অধিকতর তদন্ত করে জাহালমকে নির্দোষ হিসেবে কমিশনে প্রতিবেদন দেন।
দুদকের কেউ কেউ বলছেন, ২০১১ সালে ডিএডি ও এডি হিসেবে দুদকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তারাই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সদ্য নিয়োগ পাওয়া অনভিজ্ঞ ওই সব কর্মকর্তা সরেজমিন মাঠ তদন্ত না করে, টেবিল ওয়ার্ক করেই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ যেখানে মামলার আসামি হিসেবে জাহালমকে অন্তর্ভুক্ত করেনি, সেখানে তদন্ত কর্মকর্তারা কিভাবে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করল? একজন আর দুজন কর্মকর্তা নন, ৯ তদন্ত কর্মকর্তা ২৬টি মামলার তদন্ত করলেন, তাঁদের কেউই আবু সালেককে চিহ্নিত করতে পারলেন না! আবার সেসব কর্মকর্তা যখন সিরিয়াসলি তদন্ত করলেন, তাতে আবার জাহালম নির্দোষ প্রমাণিত হন। এসব কর্মকর্তার কারণে দুদকের ভাবমূর্তি অনেক ক্ষুণ্ন হয়েছে সারা দেশে। আর সেই তাঁরাই আবার পেয়েছেন পদোন্নতি; ৯ জনের মধ্যে আটজনই পদোন্নতি পেয়ে বিভিন্ন স্থানে পদায়ন হয়েছেন।
জাহালমের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সদ্য পদোন্নতি পাওয়া উপপরিচালক রাফি মো. নাজমুস সাদাত বলেন, ‘আবু সালেক যে ছবি দিয়ে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট করেছিলেন, সেই ছবি এবং জাহালমকে ব্যাংক কর্মকর্তারা এসে শনাক্ত করায় জাহালমের নামে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল। জাহালমের গ্রামের ইউনিয়ন চেয়ারম্যানও তাঁকেই শনাক্ত করেন। তবে অধিকতর তদন্তে ঠাকুরগাঁও গিয়ে নেপথ্যের মূল হোতা আবু সালেককে চিহ্নিত করা হয় এবং জাহালমকে নির্দোষ হিসেবে প্রমাণ পাই।’ তিনি দাবি করেন, এই বিষয়ে বড় ধরনের সিন্ডিকেট জড়িত।
সম্প্রতি উপসহকারী পরিচালক থেকে সহকারী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া মামলার আরেক তদন্ত কর্মকর্তা সিলভিয়া ফেরদৌসের মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু মামলাটি চলমান আছে, এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না।’
মামলার তদারককারী হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন পরে অবসরে যাওয়া দুদকের পরিচালক নূর আহম্মদ। তাঁর মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে কাগজপত্র না দেখে কিছুই বলতে পারছি না। অনেক দিন আগের ঘটনা। এখন সব কিছু মনেও নেই।’