অনলাইন ডেস্ক: সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বিভাগীয় মামলা নিরপেক্ষ তদন্তে একটি স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বর্তমানে এসব মামলার তদন্ত করেন সংশ্নিষ্ট বিভাগেরই কর্মকর্তারা। এতে নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার কোনোটিই সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় মামলাগুলোর তদন্ত কার্যক্রম সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের মাধ্যমে পরিচালনার বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তে সম্পূর্ণ পৃথক কর্তৃপক্ষের অধীনে পরিচালনা করা হবে। এরইমধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ কর্তৃপক্ষ গঠনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করেছে। শিগগিরই এর কাঠামো চূড়ান্ত করা হবে। সরকারি একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার পর মন্ত্রিসভায় ব্যাপক চমক দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের মন্ত্রিসভায় বেশিরভাগ স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতারা স্থান পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করতে প্রশাসনেও শুদ্ধি অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বড় মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো পরিদর্শন শুরু করেছেন। সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। এ অবস্থায় দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ার অংশ হিসেবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর আগে গত বছর সচিব সভার আলোচনায়ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত ও বিচারের আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়টি স্থান পায়। এটি গঠনে সংশ্নিষ্টদের নির্দেশও দেওয়া হয়। কিন্তু পরে অজানা কারণে এটি আবার অন্ধকারে চলে যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স ঘোষণায় এ বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আলাদা কর্তৃপক্ষ হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বিচার সম্পন্ন হবে। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দুর্নীতি ও অসদাচরণে নিরুৎসাহিত হবেন। কারণ তাদের মধ্যে একধরনের বিচারের ভয় ঢুকবে। আর তাদের কাছ থেকে প্রকৃত সেবা পাওয়া যাবে।
সূত্র জানায়, সাবেক একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে কর্তৃপক্ষের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হবে। মামলা তদন্তে একাধিক টিম থাকবে। এসব টিমের নেতৃত্বে থাকবেন উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা। অভিযোগের ধরন অনুযায়ী টিমগুলো কাজ করবে। মূলত অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদেরই এসব পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে সাবেক আমলাদের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া নিরপেক্ষ তদন্ত শেষে বিচারের জন্য একটি বোর্ড গঠন করা হবে। সাবেক অতিরিক্ত সচিব বা সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বোর্ডের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। এ বোর্ড অপরাধের তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শাস্তি ঘোষণা করবে। কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী শাস্তির বিপরীতে আপিল করতে চাইলে কর্তৃপক্ষ প্রধানের কাছে আপিল করতে পারবেন। এ বোর্ড গঠনের আগে এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করবে সরকার।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবছর হাজার হাজার বিভাগীয় মামলা হয়। এসব মামলার খুব কমই যথাসময়ে নিষ্পত্তি হয়। নিষ্পত্তি হলেও তাতে গলদ থেকে যায়। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা একই বিভাগের অন্য কর্মকর্তা তদন্ত করায় তা নিরপেক্ষ হয় না। বেশিরভাগ বিভাগীয় মামলার নিষ্পত্তি হয় আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। অথচ এসব মামলায় কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগও থাকে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনে বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মের শত শত অভিযোগ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়লেও উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তার বেশিরভাগই তদন্ত পর্যায়েই নিষ্পত্তি করা হচ্ছে। কোনো ক্ষেত্রে তদন্ত শেষে বিভাগীয় মামলা হলেও দায়সারা শুনানি শেষে সেগুলো শাস্তি ছাড়াই নিষ্পত্তি করে দিচ্ছে মন্ত্রণালয়। আবার অনেক অভিযোগ আমলেই নিচ্ছে না সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়। এতে মাঠপর্যায়সহ সব ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা অপকর্মে উৎসাহ পাচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, কর্মকর্তাদের অভিযোগের বিচার না হওয়ায় প্রশাসনে দুর্নীতি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে মাঠ প্রশাসনে সীমাহীন দুর্নীতি চলছে। এসিল্যান্ড অফিস থেকে শুরু করে বিভাগীয় কমিশনার অফিস পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে চলছে দুর্নীতির মহোৎসব। টাকা ছাড়া এসব অফিসে কোনো কাজ হয় না। গ্রাহকদের সেবার পরিবর্তে ভোগান্তিই নিত্যসঙ্গী। মাঠপর্যায়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পদস্থ কর্মকর্তাদের একটি রেট বেঁধে দিচ্ছেন। প্রতি মাসে প্রতি স্টেশন থেকে কত টাকা দিতে হবে, তারও একটি তালিকা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে মাঠপ্রশাসনে।
এ ব্যাপারে জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমেদ বলেন, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সঙ্গে সঙ্গেই তদন্ত করা হয়। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে তো আর বিচার করা যায় না। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত হয়, ঠিক তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তিনি বলেন, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসে, তার বেশিরভাগেরই সত্যতা মেলে না। এমনও দেখা যায়, কর্মকর্তারা কাজ করতে গিয়ে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগে, তারা একটি অভিযোগ দিয়ে বসে। কিন্তু এগুলো বিবেচনায় নিলে কর্মকর্তারা সাহস করে কাজ করতে পারবেন না। সরকারি কাজে ব্যাঘাত ঘটবে। তবে কারও বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অপর একটি সূত্র জানায়, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো অভিযোগ আসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে অভিযোগ এলেও তা তদন্তের জন্য চলে আসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে। আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ ধরনের কাজ করে শৃঙ্খলা বিভাগ। শৃঙ্খলা বিভাগে জনবল সংকট ও কর্মকর্তাদের কিছুটা অনীহার কারণে অভিযোগগুলো মাসের পর মাস পড়ে থাকছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ তদন্ত ও বিচারে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা ভাবছে সরকার।
এ বিষয়ে একাধিক সাবেক আমলা বলেন, কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে তার বিচার না হওয়ার পেছনে রয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনীহা ও অবহেলা। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তার তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার ওপর। ওই কর্মকর্তা ইচ্ছা করেই তার অধীনস্থ কর্মকর্তার অভিযোগ আমলে না নিয়েই নির্দোষ দেখিয়ে একটি রিপোর্ট দেন। ওই পর্যন্ত শেষ হয় অভিযোগের ভবিষ্যৎ। আবার কোনো ক্ষেত্রে তদন্তে তাকে দোষী করে রিপোর্ট পাঠালেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শুনানিকালে তা শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে তার তদন্ত নিয়ে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে তদন্ত করানোর দাবি করেন তারা।
অভিযোগ রয়েছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মচারীদের একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। মাঠপ্রশাসনের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে ওই সিন্ডিকেট সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে তার অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত করে। পরে ওই কর্মকর্তা সিন্ডিকেটের সঙ্গে দেনদরবার করে তার অভিযোগের কপি সরিয়ে ফেলে।
সূত্র জানায়, গত এক বছরে প্রায় হাজারখানেক অভিযোগ জমা পড়েছে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লাই ভারী। তাদের বিরুদ্ধে অসদাচরণ, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যহারের অভিযোগই বেশি পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগের উল্লেখযোগ্য কোনো বিচারও হয়নি এ সময়ে। কোনো কোনো অভিযোগের তদন্ত দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তদন্ত দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে আছে। আবার তদন্ত রিপোর্ট জমা দিলেও নামমাত্র বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনও ঘটনা ঘটেছে- কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা সেভাবেই রয়ে গেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা শাখায়। গত অক্টোবরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সাবেক এক এমপি অভিযোগ দেন তার নির্বাচনী এলাকার এক ইউএনওর বিরুদ্ধে। ইউএনওর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অসদাচরণের ফিরিস্তি তুলে ধরে একটি ডিও লেটার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। ওই ইউএনওকে বদলিরও সুপারিশ করেন তিনি। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ওই এমপির ডিও লেটার পাত্তাই দেয়নি বলে জানা গেছে। সাতক্ষীরার এক এমপি তার নির্বাচনী এলাকার এক এসিল্যান্ডের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে ডিও লেটার দেন। এটি তদন্ত হলেও তা ওই পর্যায়ে শেষ হয়েছে।
জানা যায়, কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী বিচার হওয়ার কথা। বিধিমালা অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তা তদন্তে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অভিযোগ প্রমাণ হলে শুনানির ব্যবস্থা করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। শুনানি শেষে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে রায় দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তদন্ত সন্তোষজনক না হলে পুনরায় তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান রয়েছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে চাকরি থেকে বরখাস্ত করারও বিধান রয়েছে। কিন্তু বতর্মানে দেখা যাচ্ছে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণ হলেও সর্বোচ্চ লঘুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। এতে তারা দুর্নীতিতে উৎসাহিত হচ্ছেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটছে।