দেশের খবর: রাজধানীর হাজারীবাগে জরাজীর্ণ যে পাঁচতলা ভবন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যালয় হিসেবে দেখিয়ে প্রতারণা চালানো হতো, তার বাইরের দেয়ালে শেওলা পড়ে গেছে। ভেতরে এতটাই অন্ধকার যে গা ছমছম করে। গত ৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ওই বাড়িতে গিয়ে দরজায় টোকা দিলে তাত্ক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া মেলেনি। মিনিট দশেক পর ভেতর থেকে পরিচয় জানতে চাইল এক কিশোরী। পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেয়ে জানা গেল, তার নাম আনিছা আক্তার। আর কোনো প্রশ্ন না করেই আনিছা বলে উঠল, ‘বুঝছি, আমার বাবার খোঁজে আইছেন। তয়, গত রাইতে বাবারে র্যাব ধইরা নিয়া গ্যাছে।’ কারণ জানতে চাইলে তার স্পষ্ট জবাব, ‘হুনছি বাবা দুদক কর্মকর্তা পরিচয়ে মানুষরে ধোঁকা দিয়া টাকা নিছে। তয় কথা সত্য। বাবা কাজটা ঠিক করে নাই। এখন আমরা বিপদে আছি।’
আনিছার বাবার নাম আনিসুর রহমান বাবুল। জানা যায়, হাজারীবাগের সনাতনগড় বউবাজারসংলগ্ন ৩৮ নম্বর বাড়িটিকে দুদকের অফিস হিসেবে দেখিয়ে প্রতারণা করত একটি চক্র। ওই চক্রের হোতা আনিসুর রহমান বাবুল। বাড়ির একটি ফ্লোরে দুটি রুম ভাড়া নিয়ে স্ত্রী ও দুই সন্তানসহ দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিলেন তিনি। বাড়ির মালিক হাসেম মোল্লার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবুল র্যাবের হাতে ধরা পড়ার পর তিনি জানতে পারেন যে তাঁর এই ভাড়াটিয়া একজন প্রতারক। এর পরই বাবুলের পরিবারকে বাসা ছেড়ে দিতে বলেছেন তিনি।
র্যাব ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, হাজারীবাগ এলাকার একটি বিকাশের দোকানকেও কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতেন বাবুল। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘ঘুষ’ হিসেবে যে অর্থ পাঠাতেন, সেই কার্যালয়ে তা গ্রহণ করত বাবুলের লোকজন। বিভিন্নজনের নামে মোবাইল ফোনের সিম সংগ্রহ করে সেখানে বিকাশ হিসাব খোলা হতো। ‘ঘুষ’ আদায়ের কাজে তারা ব্যবহার করে মোট ২১টি মোবাইল ফোন, ১৭টি সিম কার্ড ও একটি সরকারি টেলিফোন ইনডেক্স। ওই সব মোবাইল ফোন সিমের প্রকৃত মালিক হলেন ওই চক্রের সদস্য হাজারীবাগের বিলকিস, আকলিমা ও জানু বেগম; চট্টগ্রামের মো. জুয়েল; মাদারীপুরের আলমাস হোসেন বিপ্লব; কক্সবাজারের আবু বাশার; মানিকগঞ্জের লাল মিয়া ও নুরুল হক। তাঁদের সিম ব্যবহার করে গত পাঁচ বছরে এক হাজারের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে চক্রটি হাতিয়ে নেয় কয়েক কোটি টাকা। এর মধ্যে চক্রের ছয় মাসের বিকাশ হিসাব পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ০১৯৪৪৩০৯৪০২ নম্বর থেকে চার লাখ ৩৭ হাজার ৪৬৫ টাকা,
০১৯৯৮১১৮৭০০ নম্বর থেকে চার লাখ ৬৯ হাজার ৩৪০ টাকা, ০১৭২১৪৯৬১৯৮ নম্বর থেকে চার লাখ ২৬ হাজার ৮৭৫ টাকা, ০১৮২২৯১৭৮৫১ নম্বর থেকে চার লাখ সাত হাজার ৩৩৫ টাকা, ০১৭৫৪৯১০৪৪৪ নম্বর থেকে ছয় লাখ ৩৯ হাজার ৪৯৩ টাকা, ০১৮৪০৪৮৯৪১৭ নম্বরে চার লাখ ১৭ হাজার ২৪৩ টাকা, ০১৮২৭১৬৮৩৩৯ নম্বর থেকে তিন লাখ চার হাজার ৫৮৫ টাকা, ০১৮৩২৮৯৪৭০৯ নম্বর থেকে তিন লাখ ৯৭ হাজার ২৪৩ টাকা, ০১৬১০০৭১১১৮ নম্বর থেকে চার লাখ ১৯ হাজার ১৫৫ টাকা এবং ০১৭৮৯৫৩৯১৪০ নম্বর থেকে দুই লাখ ৬২ হাজার ৮৯২ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা। এভাবে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে রেজিস্ট্রেশন করা ১১টি বিকাশ হিসাবের মাধ্যমে গত বছরের ১ আগস্ট থেকে ছয় মাসে ৪৬ লাখ ৯ হাজার ৯২২ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি। এরই মধ্যে ওই সরকারি চাকুরেদের অনেকের নাম পেয়ে যাচাই-বাছাই করছেন র্যাব, পুলিশ ও দুদকের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
গত কয়েক দিন হাজারীবাগ এলাকায় গিয়ে বাবুলের স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবুলের ভাড়া বাসায় অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের। তারা গভীর রাত পর্যন্ত ওই বাসায় অবস্থান করে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলত। গত মঙ্গলবার বিকেলে ওই বাসায় গিয়ে আনিছার সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে ছিলেন তার খালা রিনা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার দুলাভাই (বাবুল) মানুষ হিসেবে খুব খারাপ। দুদকের লোক না হয়েও দুদক কর্মকর্তা পরিচয় দিত। বাসাটাকেও দুদকের অফিস বানিয়ে ফেলেছিল। ধরা পড়ার আগে বাসায় স্ত্রী-সন্তানকে একটি কক্ষে আটকে রেখে প্রতি রাতেই মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকত। তার সঙ্গে সব সময় দুই-তিনজন লোক থাকত। সবাই মিলে বাসায় ইয়াবা সেবন করত। ফোনে তারা কাদের সঙ্গে কথা বলত বাসার কাউকে জানাত না। আমার বোন প্রতিবাদ করলে মারধর করত।’
বাবুলের স্বজনরা আরো জানায়, সরকারি চাকুরেদের কাছে থেকে নেওয়া টাকা দিয়ে বাবুল হাজারীবাগ এলাকায় ওসান ও ডেন্টাল লাইফ নামের বিভিন্ন পণ্যের ডিলারশিপ নিয়েছিলেন। ওই সব পণ্য রাখার জন্য এলাকায় একটি স্টোররুমও ছিল তাঁর।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল স্বীকার করছেন, বাসার পাশাপাশি ওই স্টোররুমে বসেও তিনি দুদক পরিচয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ফোন করতেন।
গত মঙ্গলবার গিয়ে স্টোররুমটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় লোকজন জানায়, বাবুলকে তারা ব্যবসায়ী হিসেবে জানত।
বাবুল ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইয়াসিন তালুকদারকে গত ১ ফেব্রুয়ারি হাজারীবাগ এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব এজাহারে বলেছে, বাবুলের প্রতারকচক্রের বেশ কয়েকজন মাদারীপুরের রাজৈর থানার লুন্দী এলাকার। তাদের মধ্যে ইয়াসিন ও কুমিল্লার দাউদকান্দির ওমর কাজী নিয়মিত যাওয়া আসা করতেন বাবুলের বাসায়।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, বাবুল জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ওমর কাজীর (৫২) কাছে তাঁর প্রতারণার হাতেখড়ি। প্রতারণার কথা স্বীকার করে তাঁরা র্যাবকে বলেছেন, এভাবে যে টাকা হাতিয়ে নেওয়া যায় সেটা শুরুতে তাঁদের কাছেও ছিল বিস্ময়ের মতো। কিন্তু যাঁরা টাকা দিয়েছেন তাঁদের সবাইকে দুর্নীতিবাজ মনে হয়েছে। তাঁরা টাকা দেওয়ার সময় বলতেন যেন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা না হয়। ঘুষ হিসেবে একেকজন ৫০ হাজার থেকে এক লাখ আবার কেউ কেউ দুই লাখ টাকাও দিয়েছেন।
দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘গণমাধ্যমে প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি যে কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতারকচক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে অর্থ দিয়ে তাদের সঙ্গে আপস করেছেন। এ খবর অবশ্যই উদ্বেগজনক। আমি মনে করি যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতারকচক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন তাঁদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা উচিত।’
যেভাবে প্রতারণা : র্যাব ও পুলিশ সূত্রের পাশাপাশি কয়েক দিন ধরে প্রতারক বাবুল ও তাঁর সহযোগীদের সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টার্গেট করে তাঁরা বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে গিয়ে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের পরিকল্পনা করেন ২০১৪ সালে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা সশরীরে সরকারি দপ্তরে গিয়ে সংগ্রহ করতে শুরু করেন কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর। এরপর তাঁদের বিরুদ্ধে দুদকে দুর্নীতির মামলা প্রক্রিয়াধীন থাকার তথ্য দিতেন। তখনই ‘ঘুষ’ দিয়ে নিজেদের দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া প্রতারণার সময় নিজেদের কখনো দুদক কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম আবার কখনো সুশান্ত কুমার বর্মণ আবার কখনো দুদকের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিত প্রতারকরা। তাদের হুমকি পেয়ে অনেক কর্মকর্তা ‘ঘুষ’ দিয়ে দুর্নীতির মামলা ও হয়রানি থকে রক্ষা পাওয়ার অনুরোধ জানাতেন। সেই সুযোগে প্রতারকচক্র বিকাশ নম্বর দিয়ে মোটা অঙ্কের ‘ঘুষ’ দাবি করত। তারা বলত, ঘুষের টাকা পেলে দুর্নীতি মামলা খারিজ বা নথিভুক্ত করে দেওয়া হবে। এতেই খুশি হতেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা।
র্যাব ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে এই চক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য থাকার তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে। এদের মধ্যে বাবুল ও ইয়াসিনকে গ্রেপ্তার করেই সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি সম্পর্কেও অনেক তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
তদন্তের আওতায় ঘুষদাতারা : র্যাব-২-এর কম্পানি কমান্ডার মহিউদ্দিন ফারুকী বলেন, ‘ঘুষ দেওয়া ও ঘুষ নেয়াও অপরাধ। তাই ভুয়া দুদককে যাঁরা ঘুষ দিয়ে নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরাও অপরাধী। এ কারণে বাবুলের তথ্যের ভিত্তিতে ওই সব কর্মকর্তাকে আটক করতে তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। এ ছাড়া আলাল নামের একজন আনিসুরের কথামতো দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে এই টাকা সংগ্রহ করত। যেসব সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতি ঢাকতে প্রচারকচক্রকে টাকা দিয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কেও তদন্ত চলছে।’
হাজারীবাগ থানার ওসি মো. ইকরাম আলী মিয়া বলেন, ‘আনিসুর রহমান বাবুল ও তার সহযোগীরা একটি সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্রের সদস্য। এরা দুদক কর্মকর্তা পরিচয়ে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে, তাঁদের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। কারণ কাউকে ঘুষ দেওয়া এবং ঘুষ নেওয়াটাও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। যাঁরা ঘুষ দিয়েছেন তাঁরা অপরাধ করেছেন। এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। যেসব সরকারি কর্মকর্তা প্রতারকচক্রকে টাকা দিয়েছেন তাঁরা অপরাধ করেছেন। তাঁদের এই অর্থ দেওয়া ঘুষ দেওয়ার পর্যায়েই পড়ে।’
বাবুল ও তাঁর চক্রের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানার এসআই তাপস কুমার কুণ্ডু বলেন, দুদক পরিচয়ে প্রতারণা করে সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বাবুল ও ইয়াসিন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এর তদন্ত চলছে। তিনি জানান, র্যাব ও পুলিশের সাত কর্মকর্তা ওই মামলায় সাক্ষী হয়েছেন। এ ছাড়া হাজারীবাগ এলাকার আরো সাতজনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দুদক কর্মকর্তা বলেন, যাঁরা ভুয়া দুদক কর্মকর্তাদের ‘ঘুষ’ দিয়ে দুর্নীতি থেকে রক্ষা পেতে চেয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এভাবে কাউকে ঘুষ দেওয়াটা অন্যায়। এঁদের মুখোশ উন্মোচন করতে পারলে সেটা হবে সমাজের জন্য অনেক বড় বার্তা। তদন্ত করে ওই কর্মকর্তাদের মুখোশ উন্মোচন করা হবে।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, এরই মধ্যে কয়েকজন প্রতারককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। দুদক চেয়ারম্যান কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যাতে এই প্রতারকচক্রকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়। সূত্র: কালের কণ্ঠ।