দেশের খবর: মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি চেয়ে দেড় লাখ আবেদনকারীকে যাচাই-বাছাইয়ে ২০১৭ সালে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। সেই আবেদন আবার যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ জন্য উপজেলা ও মহানগর পর্যায়ে ফের কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটিকে দুই মাসের মধ্যে নতুন করে যাচাই-বাছাই শেষে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ কাউন্সিলে (জামুকা) প্রতিবেদন পাঠাতে হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার জামুকার ৬১তম সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন একাধিক সদস্য।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, স্থানীয় এমপি মুক্তিযোদ্ধা হলে তিনি অথবা স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার যাচাই-বাছাই কমিটির নেতৃত্ব দেবেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন ভারতীয় তালিকা বা লালমুক্তি বার্তায় তালিকাভুক্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
২০১৭ সালে ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশের ৪৭৭ উপজেলা ও মহানগর কমিটি গঠন করে ওই দেড় লাখ আবেদন যাচাই-বাছাই করা হয়। অবশ্য তখন থেকেই যাচাই-বাছাইয়ে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। কমিটির অনেকের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচিও পালন করেছিলেন আবেদনকারীরা। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তখন বিষয়টি আমলে নেয়নি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর সংশ্নিষ্ট উপজেলা ও মহানগর কমিটি জামুকায় সুপারিশ ও মূল্যায়ন সংক্রান্ত প্রতিবেদনও দাখিল করে।
দুই বছর অপেক্ষার পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ না করে গতকাল উপজেলা ও মহানগর কমিটির প্রতিবেদনগুলো ফের সংশ্নিষ্ট কমিটিতে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘২০১৭ সালে উপজেলা ও মহানগর যাচাই-বাছাই কমিটি যেসব প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল, জামুকার সভায় তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। আমরা দেখেছি কোনো কোনো উপজেলায় এক-দেড়শ’ গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা থাকলেও সেখানকার কমিটি নতুন করে তিন-চারশ’ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য সুপারিশ করেছে। এগুলো আমাদের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জামুকার সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে- যেসব উপজেলা কমিটি ১০ ভাগের নিচে সুপারিশ পাঠিয়েছে, সেগুলো গ্রহণ করা হবে। এ জন্য নতুন করে উপজেলা ও মহানগর কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। শিগগিরই সংশ্নিষ্টদের চিঠি পাঠানো হবে।’
মন্ত্রী আরও বলেন, সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। তবে সংশ্নিষ্ট উপজেলা কমিটি যেভাবে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে পূর্ণাঙ্গ তালিকা করা সম্ভব নয়। কারণ যাচাই-বাছাইয়ের জন্য মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও যে নীতিমালা তাদের দেওয়া হয়েছিল, সেটি তারা সঠিকভাবে অনুসরণ করেনি। অধিকাংশ কমিটিই ‘হ্যাঁ বা না’ লিখে মতামত দিয়ে পাঠিয়েছে, কিন্তু কেন তিনি মুক্তিযোদ্ধা বা কেন নয় সেটা তারা বলেনি।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী ২৬ মার্চের আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশের কথা বলেছিলেন। যদিও নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তখনও জামুকার পর্ষদ গঠন করা হয়নি। এ পরিস্থিতিতে মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে সংশ্নিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। পরে মন্ত্রী ফের ঘোষণা দিয়ে নিশ্চিত করেন আইনি জটিলতায় ২৬ মার্চের মধ্যে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামুকার পর্ষদ পুনর্গঠনের বিষয়টি অনুমোদন করেন। এরপর গতকাল পুনর্গঠিত জামুকার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকেই ফের মুক্তিযোদ্ধার আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয় জামুকা।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে পুনর্গঠিত কমিটির সদস্যরা হলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি, শাজাহান খান এমপি, আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি, মো.আবদুস শহীদ এমপি, মোতাহার হোসেন এমপি, শহীদুজ্জামান সরকার, সাবেক সচিব যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রশিদুল আলম ও মেজর (অব) ওয়াকার হাসান বীরপ্রতীক।
জামুকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি সরকারি সংস্থা। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি প্রদান ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাতিলসহ এ সংক্রান্ত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে সংস্থাটি। বিধি অনুসারে পদাধিকারবলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জামুকার উপদেষ্টা।
পুনর্গঠিত কমিটির এক সদস্য বলেন, তাড়াহুড়া করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রকাশ করলে এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আবারও প্রশ্ন উঠবে। তা ছাড়া যে তালিকা কমিটিগুলো পাঠিয়েছে তাও অসম্পূর্ণ। এ জন্য ফের যাচাই-বাছাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, জামুকার সভায় ৬০ জন ভুয়া এবং কিছু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন করে গেজেটভুক্ত হয়েছেন ৩৫ হাজার ৪৮৯ জন। সব মিলে দেশে এখন গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুই লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৮। ভাতা পাচ্ছেন এক লাখ ৮৭ হাজার ৯৮২ জন। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে ছয়বার তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন রয়েছে।
এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সারাদেশে ৪৭০ উপজেলা ও মহানগর কমিটি গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করে সরকার। এতে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অনলাইনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য আবেদনকারী এক লাখ ২৩ হাজার ১৫৪ জন এবং সরাসরি ১০ হাজার ৯০০ জন ও ত্রুটিপূর্ণ আবেদনকারী পাঁচ হাজার ৫৫৩ জনকে যাচাই-বাছাইয়ে অংশ নিতে বলা হয়। এ ছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ‘ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা’র অভিযোগ ওঠা ৪৫ হাজার সনদ ও গেজেটধারীকে যাচাই-বাছাইয়ে অংশ নিতে বলা হয়। একই নির্দেশ দেওয়া হয় ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘ভুয়া সনদ’ গ্রহণকারীদেরও। যাচাই-বাছাইয়ের পর সংশ্নিষ্ট কমিটি জামুকায় প্রতিবেদন দাখিল করে।
জামুকা সূত্রে জানা গেছে, ৪৭০ উপজেলা ও মহানগর কমিটির মধ্যে আইনি জটিলতায় ১১০ কমিটি এখনও প্রতিবেদন দিতে পারেনি। বাকি ৩৬০ কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া গেলেও তাতে প্রচুর অসঙ্গতি ও ভুলত্রুটি রয়েছে।