দেশের খবর: মুন্সীগঞ্জের ঐতিহাসিক নাটেশ্বর, রঘুরামপুর ও বল্লাল বাড়িতে উৎখননে বেরিয়ে আসছে একের পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। উঠে আসছে হরেক রকমের মৃৎপাত্র, ধাতব ও পাথরের বস্তু, উদ্ভিজ্জ ও প্রাণিজ অবশেষ। এসব প্রত্ন পরীক্ষায় তথ্য মিলেছে, নাটেশ্বর বৌদ্ধ বসতি হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। দুটি বসতির সময়কাল ৭৮০-৯৫০ খ্রিস্টাব্দ ও ৯৫০-১২২৩ খ্রিস্টাব্দ। সে হিসাবে এই জনপদে সভ্যতার শুরু আজ থেকে ১২৩৯ বছর আগে।
মুন্সীগঞ্জে বিক্রমপুর অঞ্চলে ‘প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা’ শীর্ষক কর্মসূচির দ্বিতীয় পর্যায় ২০১৮-১৯ এ আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত প্রেস কনফারেন্সে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে, এসব আবিষ্কার মুন্সীগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের প্রাচীন ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে, বিকাশ ঘটাবে পর্যটন শিল্পের।
টঙ্গিবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বর দেউল এলাকায় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের আয়োজনে প্রেস কনফারেন্সে উৎখননে আবিষ্কৃত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। সঞ্চালনা করেন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা কর্মসূচির গবেষণা পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহযোগিতায় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে বিক্রমপুর অঞ্চলে ‘প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা’ শীর্ষক কর্মসূচিটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০১০ সাল থেকে চলা প্রত্ন খননে আবিষ্কৃত বিভিন্ন নিদর্শন সাক্ষ্য দেয়, এই অঞ্চলে হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে সভ্যতার শুরু হয়।
২০১০-১৩ সময়কালে বিক্রমপুরের ৯টি স্থানে পরীক্ষামূলক উৎখননকাজ পরিচালিত হয়। রামপাল ইউনিয়নের রঘুরামপুর গ্রামে বিক্রমপুরী বৌদ্ধ বিহারের ছয়টি ভিক্ষু কক্ষ, একটি মণ্ডপ ও পঞ্চস্তূপ আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সাল থেকে নাটেশ্বর দেউলে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে বেরিয়ে আসতে থাকে বৌদ্ধ মন্দির, অষ্টকোণাকৃতি স্তূপ, ইটের রাস্তা, নালা ইত্যাদি। প্রায় ১০ একর ঢিবিতে উৎখননকাজের বিশালতা ও সংরক্ষণের কথা চিন্তা করে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন চীনের হুনান প্রাদেশিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউটকে আমন্ত্রণ জানায়। ২০১৪ সাল থেকে যৌথভাবে নাটেশ্বর দেউলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৩-১৮ সাল পর্যন্ত উৎখননে পাঁচ হাজার বর্গমিটারের বেশি এলাকা উন্মোচিত হয়েছে এবং তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেটা পরীক্ষাগারে ২৬টি কার্বন-১৪ তারিখ নির্ণয় করা হয়েছে। স্তরায়ণ ও কার্বন-১৪ তারিখের ভিত্তিতে নাটেশ্বর বৌদ্ধ বসতির দুটি সময়কাল পাওয়া গেছে—প্রথমটি ৭৮০-৯৫০ খ্রিস্টাব্দ ও দ্বিতীয়টি ৯৫০-১২২৩ খ্রিস্টাব্দ।
নাটেশ্বর প্রত্নস্থানে আবিষ্কৃত অষ্টকোণাকৃতির স্তূপটি বৌদ্ধদের আটটি পবিত্র মন্ত্র অষ্টমার্গকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সাধারণত স্তূপ স্থাপত্যের মধ্যে বৌদ্ধ দর্শনের বিভিন্ন দিক প্রতীকী রূপে প্রকাশ পায়। অসাধারণ স্থাপত্যিক নিদর্শন দুটি পর্যায়ে নির্মিত ও ব্যবহৃত হয়েছিল। স্থাপত্যটির ভিত্তি-দেয়ালে ঝামা ইটের ব্যবহার তৎকালীন প্রকৌশলীর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর বহন করে।
চলমান প্রত্নতাত্ত্বিক খননে আরো অনেক স্থাপত্যিক নিদর্শন ও প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হচ্ছে। উৎখনন আরো অগ্রসর হলে আরো অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। তাঁরা বলছেন, বাঙালি বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থানে অতীশ দীপঙ্করের সমসাময়িক বৌদ্ধ বিহার, বৌদ্ধমন্দির, অনন্য বৌদ্ধ স্তূপ, বিশেষ ধরনের রাস্তা ও অন্যান্য আবিষ্কার বাংলাদেশসহ বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করবে। বিক্রমপুরের নাটেশ্বর বিশ্ব-বৌদ্ধ তীর্থকেন্দ্র এবং পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে।