নিজস্ব প্রতিবেদক: সাতক্ষীরার সরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী হয়রানির কথা সবাই জানেন। কর্তৃপক্ষ বলে জনবল নেই, ওষুধ নেই, মেশিন নষ্ট, বরাদ্দ নেই। যেকোন টেস্ট করতে হলে যন্ত্রপাতি নষ্টের অজুহাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়। কিন্তু এখন জানা যাচ্ছে যে, এই নেই নেই সংস্কৃতির মধ্যে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সেবান মান উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ১২ কোটি টাকা সম্পূর্ণ লুণ্ঠন করা হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোকে পঙ্গু বানিয়ে গরিব মানুষের স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার শেষ সুযোগটুকু পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছেন এই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত দুর্নীতিবাজ লোকগুলো। এরা মিটিং-এ লম্বা লম্বা কথা বলে পাশের রুমে গিয়ে লুটের টাকার ভাগের খামটি গ্রহণ করে সবার আগে।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের সেবার মান উন্নত করতে বরাদ্দের ১২ কোটি টাকার পুরোটাই লুট হয়ে গেছে! আরিচা পার হয়ে তা আর সাতক্ষীরায় আসেনি। তবে সাতক্ষীরা থেকে ইতোমধ্যে বিল পরিশোধ হয়ে গেছে। এমনকি ভারী এসব যন্ত্রাংশ সদর হাসপাতালের যেসব কর্মকর্তা (সার্ভে কমিটি) গ্রহণ করেছেন তারাও জানেন না। তাদের স্বাক্ষর নকল করে এসব যন্ত্রাংশ চলমান অবস্থায় বুঝে পেয়েছেন বলে লিখেও দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে উপ-সচিব হাছাম মাহমুদসহ ৩ সদস্যের একটি টিম আকষ্মিক ঢাকা থেকে সাতক্ষীরায় এসে বরাদ্দকৃত টাকার ভারী যন্ত্রাংশ দেখতে চাইলে থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়ে। হাসপাতালের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালি নেতার ইন্ধনে এত বড় দুর্নীতি হয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই।
সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলামের সাথে এ ব্যাপারে কথা বললে তিনি জানান, মঙ্গলবার সকাল ১০টার দিকে আমি হাসপাতালে আসার পর আমার সেল ফোন বাজতে থাকে। রিসিভ করতেই আমাকে জানানো হয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৩ সদস্যের একটি টিম আসছে, আপনি হাসপাতালে থাকেন। কথা বলতে হবে। তিনি আসার আহব্বান জানানোর ৫ থেকে ৭ মিনিটের মধ্যে টিম হাসপাতালে ঢুকে পড়েন এবং জানতে চান বিগত ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দের উপর ভারী যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য টেন্ডার আহবান করা হয়। সংশ্লিষ্ট টেন্ডার অনুযায়ী ঢাকার মার্কেন টাইল ট্রেড কোম্পানী এসব মালামাল সরবরাহের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। যথারীতি তারা ১২ কোটি টাকার স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন মালামাল সরবরাহ করেছেন এবং তা আপনারা বুঝে পেয়েছেন মর্মে লিখেও দিয়েছেন। এসব মালামাল কোথায় আছে আমরা দেখবো।
আকষ্মিক পরিদর্শনে আসা টিমের প্রশ্ন শুনে সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম হতবাক। তিনি বলেন, ওই সময়ে আমি সিভিল সার্জনের দায়িত্বে ছিলাম না। কে ছিল খুঁজতে গিয়ে নাম আসে ডা. তৌহিদুর রহমানের। ১৩-০৩-১৭ থেকে ১১-১১-১৮ পর্যন্ত ডা. তৌহিদুর রহমান সাতক্ষীরায় সিভিল সার্জনের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনিই এ বিষয়ে বলতে পারবেন। একে একে সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান, সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, স্টোর কিপার একে ফজলুল হকও চলে আসেন সিভিল সার্জনের রুমে। সেখানে আরও ডাকা হয় এসব পণ্য বুঝে নেয়া সার্ভে কমিটির সদস্য ডা. ফরহাদ জামিল, ডা. আসাদুজ্জামান মেডিসিন ও ডা. শরিফুল ইসলাম সার্জনকে। তাদেরকে দেখানো হয়, আপনারা ভারী এসব যন্ত্রাংশ চলমান অবস্থায় বুঝে পেয়েছেন লিখে স্বাক্ষর করে দিয়েছেন। কোথায় সেসব যন্ত্রাংশ। তারা ৩জনই ব্যাপারটি জানেন না বলে পরিদর্শন কমিটিকে জানান। একই সাথে তাদের স্বাক্ষর দেখে নকল বলেও ৩জনই দাবি করেছেন।সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিসের স্টোর অফিসার ডা. জয়ন্ত সরকার জানান, আমি স্টোর অফিসার। নিয়ম অনুযায়ী সমস্ত মালামাল আমি সার্ভে কমিটির নিকট থেকে গ্রহণ করবো, তারপর স্টোর কিপার ফজলুল হক তা বিভিন্ন দপ্তরে সিভিল সার্জনের অনুমতি সাপেক্ষে প্রেরণ করবেন। অথচ আমি জানিই না, এধরণের কোন যন্ত্রাংশ আমি গ্রহণ করিনি। তিনি আরও বলেন, তৎকালিন সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমান ও স্টোর কিপার ফজলুল হক এসব যন্ত্রাংশ গ্রহণ করেছেন মর্মে অডিট টিম আমাদেরকে জানিয়েছেন। তবে এখন কিছু কাটুন এসেছে তার মধ্যে কি আছে, কোন যন্ত্রাংশ না ইট ভরা বাক্স তাও জানি না। যেটি আমরা কেউ রিসিভ করেনি।
বৃহস্পতিবার সকালে কথা হয় সিভিল সার্জন অফিসের হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমানের সময়ে উক্ত টাকার টেন্ডার আহবান করা হয়। সে অনুযায়ী ঢাকার মার্কেন টাইল ট্রেড কোং আমাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন। তারা সরবরাহ করেছেন পোর্ট এ্যাবল এক্স-রে মেশিন ৪টি। যার প্রতিটির মূল্য ২৩ লাখ টাকা। আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন ৪টি, সিলিং ওটি যন্ত্রাংশ এক সেট, নেবু লাইজার মেশিন ১৮টা, স্টীল ল্যাম্প ১টা, চোখ পরিক্ষার মেশিন ১টা। যা প্রায় ৮৫ হাজার টাকা দাম, রেটিনোস্কপ ১টা, ডেন্টাল যন্ত্রাংশ এক সেট, সাকশান ইউনিট ১টা ও ওয়াটার বাথ রয়েছে। এসব পণ্য চলতি অর্থ বছরের বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে আসার কথা।কোন যন্ত্রাংশই এখানে আসেনি, ঠিকাদারকে বিল পরিশোধ করা হয়েছে এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি দেখেন বারান্দায় পড়ে আছে। এখন আসবে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশ থেকে আনতে হয়, তাই দেরি হয়েছে। তাহলে যন্ত্রাংশ সরবরাহের আগে বিল পরিশোধ হল কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে লেখার দরকার নেই ভাই, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। প্লিজ লিখেন না। তবে রাতে এ নিউজ লেখার সময় হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেনের পক্ষে একজন ফোন করে বলেন, আপনার সাথে আমি রাতেই একটু দেখা করতে চাই। আপনি কোথায় আছেন বলেন, আমি সেখানে আসছি।
এদিকে এসব যন্ত্রাংশ বুঝে নেয়া সার্ভে কমিটির আহবায়ক ডা. আসাদুজ্জামান (মেডিসিন) রাতে সেলফোনে জানান, এ বিষয় সম্পর্কে আমি বা আমরা কেউ কিছুই জানিনা। কবে কমিটি হয়েছে আর কারা করেছে, কি করেছে, তা বলতে পারবো না। তবে ঢাকা থেকে অডিট টিম আসার পর জানতে পেরে বৃহস্পতিবার সিভিল সার্জন বরাবর লিখিত অভিযোগ করে বিষয়টি প্রতিকার দাবি করেছি। ঘটনার সাথে যারা সংশ্লিষ্ট তাদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার জন্য বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কমিটির দায়িত্ব পালন করাকালিন সেই সব স্বাক্ষর বা সিল নকল করা বা স্ক্যানিং করে বসানো হয়েছে বলে মনে করছি।
কমিটির সদস্য সদর হাসপাতালের সাবেক আরএমও ডা. ফরহাদ জামিল রাতে জানান, ঘটনা সবই শুনেছেন, আমরা কিছুই জানিনা। এটাতে আমাদেরকে ব্যবহার করে কেউ কেউ ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে।
এছাড়াও কমিটির আরেক সদস্য ডা. শরিফুল ইসলাম সার্জারীকে রাতে ফোন দেয়া হলে তার ফোনটি অন্য কেউ রিসিভ করে বলেন, স্যার- এখন অপরেশনে আছেন, এক ঘন্টা পরে কথা বলেন।দুপুরে সাবেক সিভিল সার্জন ডা. তৌহিদুর রহমানের সাথে কথা হলে তিনি সেলফোনে জানান, বিধি মোতাবেক টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিাকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। যথাযথভাবে মালামাল এসেছে এবং বুঝে নেয়া হয়েছে। পার্ট পার্ট বিলও পরিশোধ হয়েছে। এখানে কোন দুর্নীতি বা অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, আমি ২ মাস অসুস্থ, এখন ঢাকায় আছি চিকিৎসার জন্য (অথচ তিনি সাতক্ষীরায় আছেন)। স্বাক্ষর জালিয়াতির বিষয়ে তিনি শুনে বলেন, আমি ঢাকায় আছি। ফিরে এসে দেখছি কি করা যায়।
এদিকে রাতে সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, এই ঘটনাটি যখন ঘটেছে তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। সুতরাং কি হয়েছে আর কি করেছে আর কারা করেছে তার কিছুই বলতে পারবো না। তবে ঘটনাটি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অসহায়ের মত বললেন, এখানে অনেক হাত লম্বা মানুষ জন রয়েছে, আমার কিছুই করার নেই। তিনি রাতে এক প্রশ্নের জবাবে আরও জানান, যে সার্ভে কমিটির নাম ও স্বাক্ষর দেখানো হয়েছে, তারা সকলে মিলে একটি অভিযোগ দিয়েছেন আমার কাছে। আমি তদন্ত টিম গঠন করে রিপোর্ট আসলে তখন দেখবো কি করা যায়। পাশাপাশি দিন দুপুরে এত বড় দুর্নীতি সদর হাসপাতালসহ আশপাশের মানুষ জানার পর বেশ হতবাক হয়েছেন। মূল সংবাদটি দৈনিক পত্রদূতের সৌজন্যে প্রাপ্ত।