বিদেশের খবর: ভারতের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণায় তিস্তা নদীর পানি বণ্টনে রাজি না হওয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখন ‘বাংলাদেশ’ চলে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। তারা অভিযোগ তুলছেন, মমতা তার রাজ্যকে ‘আর একটা বাংলাদেশ’ বানিয়ে ছাড়ছেন। শুধু অভিযোগ তোলাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু হিন্দু ভোটারদের আকৃষ্ট করতে মমতাকে বাংলাদেশ চলে যাওয়ার জন্য প্যারোডি গান বানিয়ে রাজ্যময় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিজেপি নেতা ও সমর্থকরা অভিযোগ করছেন, রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমানদের তোষণ করার নীতি নিয়ে তাদের ভোটব্যাংকের ভরসাতেই আরও একবার নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভিন্ন জনসভা থেকে বিজেপির নানা স্তরের নেতা-নেত্রীরা তাই মমতার উদ্দেশে হুঙ্কার দিচ্ছেন, ‘‘মনে রাখবেন এটা পশ্চিমবঙ্গ। এটাকে দ্বিতীয় ‘বাংলাদেশ’ বানানোর চেষ্টা করবেন না।’’
বিখ্যাত লোকগীতি ‘ও তুই লালপাহাড়ির দ্যাশে যা’-র প্যারোডি করে বিজেপি সমর্থকরা গানও বেঁধেছেন ‘ও পিসি তুই চলে যা, বাংলাদেশে চলে যা’। এই গান বিজেপির সমর্থকরা বিপুল হারে ছড়িয়েও দিচ্ছেন ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে। ইউটিউবেও এই প্যারোডি গানের বেশ কয়েকটি সংস্করণ পাওয়া যাচ্ছে, এই ভোটের মৌসুমে হাজার হাজার মানুষ তা দেখছেনও। সেই গানেই রাজ্যের মুসলিম সমাজের দিকে ইঙ্গিত করে এমন একটি লাইনও আছে, ‘তুই যে শুধু ওদের দেখিস, তোর জন্ম কোন দ্যাশে রে, জন্ম কোন দ্যাশে?’
প্রসঙ্গত কলকাতার রেড রোডে ঈদের নামাজের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সেই ছবিও ব্যবহার করা হচ্ছে এই গানে। কাজেই ‘ওদের’ বলতে কাদের কথা বোঝানো হচ্ছে তা একেবারেই পরিষ্কার। এভাবে নির্বাচনি প্রচারণাকে সাম্প্রদায়িক করার চেষ্টা চলছে দেশটিতে। এছাড়াও অপর একটি ভিডিওতে গানটির সঙ্গে একটি এনিমেটেড ভিডিও জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেখানে মমতাকে মোদির ভাস্কর্যে গিয়ে ধাক্কা খেতে দেখা যায়। একই গানের আরেকটি ভিডিওতে মমতার বিভিন্ন ধরনের ছবির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে করা একটি প্রতিবাদ সমাবেশের ছবিও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশে সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হাসি মুখে কথা বলছেন এমন একটি ছবিও একটি ভিডিওতে ব্যবহার করা হয়েছে।
আর, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে এই কথিত ‘মুসলিম তোষণে’র অভিযোগকে তুলে ধরতেই কার্যত ‘বাংলাদেশ’ শব্দটিকেও বারবার প্রয়োগ করছে বিজেপি নেতৃত্ব। কারণ, প্রতিবেশী বাংলাদেশ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ, এটা কারও অজানা নয়।
প্রসঙ্গত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গবাসী ‘দিদি’ সম্বোধন করলেও সম্প্রতি ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্তরসূরী হিসেবে গড়ে তুলছেন—এমন আলোচনা শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যঙ্গ করে ‘পিসি’ বলে ডাকছেন।
ঘটনাচক্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের হয়ে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনি প্রচার করে এই অভিযোগকেই আরও উসকে দিয়েছেন দুজন বাংলাদেশি অভিনেতা– জনপ্রিয় তারকা ফেরদৌস ও ইদানিংকার টেলি-তারকা গাজী আব্দুন নূর।
ফেরদৌস যেভাবে রায়গঞ্জ আসনে তৃণমূল প্রার্থীর হয়ে রোড শো ও ভোটের প্রচার করেছেন তার জেরে তাকে ভারত ছাড়তে হয়েছে অত্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। আর কলকাতার কাছে দমদমে তৃণমূলের সৌগত রায়ের হয়ে প্রচারে নেমে একই পরিণতি হয়েছে বাংলাদেশি নাগরিক গাজী আব্দুন নূরের, যিনি জি-টিভিতে ‘রাণী রাসমণি’ সিরিয়ালে অভিনয়ের সুবাদে ইদানিং কলকাতাতেও খুব জনপ্রিয় মুখ।
রায়গঞ্জ আসনের বিজেপি প্রার্থী ও রাজ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক দেবশ্রী চৌধুরী বলছিলেন, ‘বাংলাদেশি তারকাদের ভোটের প্রচারে নামিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করতে চাইছেন তা বোঝা তো একেবারেই শক্ত নয়। বাংলাদেশি ও মুসলিম কার্ড খেলে সোজাসুজি তিনি রাজ্যের মুসলিম ভোট পোলারাইজ করতে চাইছেন।
পশ্চিমবঙ্গের প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিবাজী বসুরায়ও মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনের বড় ভিত্তি রাজ্যের মুসলিম সমাজ, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
তার কথায়, ‘পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোট প্রায় সাতাশ শতাংশর মতো। এই ভোটের প্রায় পুরোটা যদি তৃণমূলের ঝুলিতে যায়, তাহলে বাদবাকি হিন্দু ভোটের একটা খুব সামান্য অংশ পেলেও তার দল অনায়াসে জিততে পারবে।’
অধ্যাপক বসুরায়ের অভিমত, ‘গত দশ বছর ধরে মোটামুটি এই ফর্মুলাতেই পশ্চিমবঙ্গে সাফল্য পেয়ে এসেছে তৃণমূল। কিন্তু এখন তার পাল্টা হিসেবে রাজ্যে হিন্দু ভোট কনসলিডেট (সংহত) করতে চাইছে বিজেপি – যার পরিণামে তাকে এখন বাংলাদেশি বলে গালিগালাজ করা হচ্ছে।’
তবে ঘটনা হল, তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করার কারণে বাংলাদেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মোটেও প্রিয় কোনও ব্যক্তিত্ব নন। অথচ ভারতের ভোটে সাম্প্রদায়িকতার খেলায় তাকে সেই ‘বাংলাদেশি’ তকমাই হজম করতে হচ্ছে!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে করা প্যারোডি গানের একটি ভিডিও:
সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন