খেলার খবর: সাকিব আল হাসানের কাছে ‘মাইন্ড সেট’ মহাগুরুত্বপূর্ণ। সামর্থ্য যদি সাফল্যের গাড়ি হয়, তবে মনের জোর অবশ্যই জ্বালানি। জ্বালানি ছাড়া গাড়ি চলে না, স্রেফ সামর্থ্য দিয়েও মাঠে বিজয়কেতন ওড়ানো যায় না। ওয়েস্ট ইন্ডিজকে উড়িয়ে দেওয়ার পর মাশরাফিদের শরীরী ভাষা বলছে, টন্টন থেকে নটিংহাম মনভর্তি জ্বালানি নিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। টার্গেট অস্ট্রেলিয়া।
এই সেই অস্ট্রেলিয়া, যে দলটির বিপক্ষে ম্যাচটি যেন বৃষ্টিতে ভেসে যায়—ঠাট্টাচ্ছলে কত প্রার্থনা শুনে আসছি কবে থেকে! গত বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ পরিত্যক্ত হওয়ার সুখস্মৃতি নিয়ে এখনো হাসাহাসি হয় দলে। বিশ্বকাপে বরাবরের দাবিদার অস্ট্রেলিয়া। ওরাই সফলতম। তাই এ দলটার পয়েন্টে ভাগ বসাতে পারাও কম কি? শ্রীলঙ্কা কেমন ভাগ্যের জোরে বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের কাছ থেকে একটি করে পয়েন্ট নিয়ে নিয়েছে না! তেমনি অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ থেকে যদি…।
সেই ‘যদি’ এখন নদীতে! এখন নটিংহামে যেন কোনো অবস্থাতে বৃষ্টি না হয়, সেটাই কাম্য বাংলাদেশ দলের। প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া হোক কি অস্ট্রিয়া, পয়েন্টের জন্য ক্ষুধার্ত যে বাংলাদেশ।
এত দিন মিচেল স্টার্ক ভীতিকর ছিলেন। প্যাট কামিন্স, নাথান কুল্টারনাইলের গতি নিয়েও চাপা আতঙ্ক ছিল বাংলাদেশ দলে। কিন্তু বিশ্বকাপের মাঝপথে এসে সেই ভয় কোথায় যেন উবে গেছে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মন থেকে। বাউন্সারের জবাবে পুল শট নিয়ে তৈরি তারা। ১৪০-এর বেশি গতির বল নিয়ে আতঙ্ক কেটে গেছে আগেই। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের একের পর এক শর্ট বল খেলে নাকে-মুখে খাওয়ার ভয়ও গেছে কেটে।
বরং সাকিব আল হাসান আর অস্ট্রেলিয়ার অফস্পিনার নাথান লায়নকে নিয়েই বেশি গবেষণা চলছে দলে। উদ্বেগটাই যে গবেষণার প্রাপ্ত ফল। সাকিবকে ঘিরে উদ্বেগ তাঁর বোলিং নিয়ে। এটা আর গোপন কিছু নয় যে বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে বোলিং খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য নন সাকিব। বিপিএল, আইপিএল এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মাঠে ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের পেলেই বেশি আক্রমণাত্মক দেখায় তাঁকে। বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের সামনে রক্ষণাত্মক বোলিং করেন তিনি। সেটা করেও সাফল্য মেলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই তো সাকিবের দুই শিকারই বাঁহাতি। তবে সেই প্রাপ্তিতে ব্যাটসম্যানের ভুলও আছে। ডানহাতি ব্যাটসম্যানের বেলায় প্রতিপক্ষের ভুল নয়, নিজের সামর্থ্যের ওপরই আস্থা রাখেন সাকিব। ডানহাতি বনাম বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের পার্থক্যটা তাঁর কাছে এতটাই তাৎপর্যপূর্ণ। ওদিকে অস্ট্রেলিয়া দলের ব্যাটিং লাইন-আপের যে নামগুলো বিশ্বকাপের আসরে উজ্জ্বলতম, সেগুলোর চারটি বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের। ডেভিড ওয়ার্নার, উসমান খাজা, শন মার্শ ও উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান অ্যালেক্স ক্যারি। অ্যারন ফিঞ্চ কিংবা স্টিভেন স্মিথের বেলায় ঝুঁকি নেই। তবে ওয়ার্নার-খাজারা উইকেটে থেকে গেলে সাকিবের বোলিং নিয়ে গভীর ভাবনায় পড়তে হবে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাকে।
এই ডানহাতি-বাঁহাতির জট আছে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়েও। বিশ্বকাপের চার ম্যাচের তিনটিতেই উদ্বোধনী জুটি থেকে পঞ্চাশোর্ধ্ব রান পেয়েছে দল। আর ৩ নম্বরে সাকিব আল হাসান তো স্বপ্নের ক্রিকেট খেলছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্যই এখন শুরুর তিন। এ টপ অর্ডারের তিনজনই আবার বাঁহাতি। পরশু রাতে বাংলাদেশ দলের কম্পিউটার অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাস নিশ্চিত ধারণা থেকেই বলছিলেন, ‘ওরা (অস্ট্রেলিয়া) মনে হয় (অ্যাডাম) জাম্পাকে বসিয়ে আমাদের সঙ্গে লায়নকে খেলাবে।’
অ্যাডাম জাম্পা এমন কোনো আহামরি লেগস্পিনার নন। আর বাঁহাতি ব্যাটসম্যান সামান্য কিছু সুবিধাও পেয়ে থাকেন লেগির বিপক্ষে। তারচেয়ে অভিজ্ঞ নাথান লায়নের অফস্পিন বেশি কার্যকর হওয়ার কথা বাংলাদেশের বাঁহাতি টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে। যে কারণে অ্যাশলে নার্সকে না খেলানো নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থিংক ট্যাংকেও বুদ্ধিসুদ্ধি নিয়েও হাসাহাসি হচ্ছে বাংলাদেশ দলে।
তবে জাম্পা কিংবা লায়ন নয়, অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ দলের মূল চিন্তা ওয়ার্নার ও স্মিথ। টিকে গেলে একাই ম্যাচ বের করে নিতে জানেন এঁরা। শুধু যে দ্রুত রান তুলবেন তা-ই নয়, রানিং বিটুইন দ্য উইকেটেও দুর্দান্ত অজিরা। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের কারণে শত্রুশিবিরেও আজকাল বন্ধুর অভাব নেই কোনো দলের। কে যেন তেমনই এক অজি বন্ধুর কাছে শুনেছেন বাংলাদেশের বিপক্ষে সিংগেলসে ডাবলস বানাবেন হরদম!
ব্যাটিং-বোলিংয়ের চেয়ে এই দুশ্চিন্তাও রয়েছে বাংলাদেশের। এই তিন দুশ্চিন্তা জড়িয়ে ধরা মানে তো নিশ্চিত হার! এমন দুর্ভাবনা নিয়ে টিম হোটেল থেকে বেরোনোর পথে দেখি এক কোণে শ্রীনিবাসের সঙ্গে কী যেন শলা করছেন মাশরাফি। কান পেতে শুনি, ‘তুমি কয়েকটা ভালো প্ল্যান দাও। আমরা ঠিক করে দেব!’ ওয়ার্নারের দল সানরাইজার্স হায়দরাবাদেরও কম্পিউটার অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাস। তাই ওয়ার্নার এ ভারতীয়র কাছে অচেনা কেউ নন। স্মিথের বিরুদ্ধেও ছক করেছেন কত। তাই অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর ব্লু প্রিন্টটা খারাপ হওয়ার কথা নয়। শুধু এক্সিকিউশনটা ঠিকঠাক হলে হয়।
টন্টন সেসব দুহাত ভরে দিয়েছে। সামর্থ্যের প্রয়োগের জন্য আত্মবিশ্বাস, মনের জোর লাগে। দলে যেটাকে বলা হয় ‘মাইন্ড সেট’। বাঁচা-মরার ম্যাচে ৪১.৩ ওভারে ৩ উইকেটে ৩২২ রান করা দলে মনের জোরের অভাব থাকে কী করে!