শিক্ষা সংবাদ: ছাব্বিশ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন নোয়াখালী সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোখতার হোসেন। ১৪তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৯৩ সালের নভেম্বরে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আড়াই দশক পেরিয়ে গেলেও ‘অধ্যাপক’ হতে পারেননি। শুধু তিনি নন, বিসিএসের একই ব্যাচের আরও অনেকেই অধ্যাপক পদে এখনও পদোন্নতি পাননি।
তবে একই ব্যাচের অনেক কর্মকর্তাই এ ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ মাউশির পরিচালকসহ (কলেজ ও প্রশাসন) বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছেন। মাউশি মহাপরিচালকের পদটি গ্রেড-১-এর পদ। একই ব্যাচের কেউ বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপে, কেউ-বা পঞ্চম ধাপে চাকরি করছেন।
এই ‘বৈষম্যমূলক’ অবস্থা সৃষ্টির কারণ একটি নিয়ম। এই নিয়মানুযায়ী বিসিএসের অন্যান্য ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি চালু থাকলেও শিক্ষা ক্যাডারে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি ঘটে। এ নিয়মের ফলে ১৪তম বিসিএসের অনেক কর্মকর্তা এখনও অধ্যাপক হতে পারেননি। অথচ ১৫ ও ১৬তম বিসিএসের অনেক কর্মকর্তা অধ্যাপক হয়ে আগেই তাদের টপকে গেছেন। এতে সরকারি কলেজে সিনিয়র শিক্ষকদের কাজ করতে হচ্ছে জুনিয়রদের অধীনে, যা তাদের মনোবেদনা ও হতাশার অন্যতম কারণ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনার অন্যতম শিকার বিসিএসের ১৪তম ব্যাচ। এ ব্যাচের ৫৯৮ জন সহযোগী অধ্যাপক পদ থেকে পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করে অধ্যাপক হওয়ার প্রহর গুনছেন। ২০১৪ সালেই এ যোগ্যতা অর্জন করেছেন তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজধানীর ঢাকা কলেজের এই ব্যাচের একজন শিক্ষক বলেন, তাদের ৫৯৮ জনকে পদোন্নতি দিলে সরকারের কোনো বাড়তি খরচও হবে না। কারণ তারা ২০১৪ সাল থেকে অধ্যাপক পদের বেতন পেয়ে আসছেন। তবে চাকরিজীবনের শেষ সময় এসে তারা এখন মর্যাদা চান। তিনি বলেন, একই বিসিএসে চাকরি পেয়ে কেউ ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদে (ডিজি, মাউশি) চলে গেল, অথচ তারা সহযোগী অধ্যাপকই রয়ে গেলেন! ইচ্ছাকৃত ঢিলেমির আশ্রয় নিয়ে এ বঞ্চনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এই কর্মকর্তার দাবি, কনিষ্ঠ হয়েও মাউশির জ্যেষ্ঠ পদে আসীন এক কর্মকর্তার বাধার কারণে এ পদোন্নতি আটকে আছে। একই ব্যাচের অন্য কর্মকর্তা রাজধানীর বাইরের একটি কলেজে কর্মরত ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিক চৌধুরী বলেন, বর্তমানে ২০১৯ সাল চলছে। দুই বছর পর ২০২১ সাল থেকে ১৪তম বিসিএসের সবাই অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটিতে (পিআরএল) যেতে শুরু করবেন। ২০২৫ সালের মধ্যে এই ব্যাচের সব কর্মকর্তা অবসরে চলে যাবেন। এখন পদোন্নতি পেলে তারা অন্তত কয়েক বছর অধ্যাপক পদে চাকরি করে অবসরে যেতে পারতেন।
১৪তম বিসিএসের কর্মকর্তা সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও বর্তমানে জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) উপপরিচালক খান রফিকুল ইসলাম জানান, ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। তার ছাত্ররা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ১০ বছরেই অধ্যাপক হয়ে গেছেন। আর তারা ২৬ বছরেও সহযোগী অধ্যাপকই রয়ে গেলেন।
মাউশির সরকারি কলেজ উইং থেকে জানা গেছে, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের ১৪তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে অধ্যাপক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেও অপেক্ষা করছেন এমন সহযোগী অধ্যাপকদের মধ্যে রয়েছেন অর্থনীতিতে ৪৯, আরবিতে ৫, ইসলামী শিক্ষায় ১৭, ইসলামের ইতিহাসে ৪৪, ইংরেজিতে ৪৮, উদ্ভিদবিদ্যায় ৪৭, গণিতে ৩৫, দর্শনে ৫২, পদার্থবিজ্ঞানে ২৮, পরিসংখ্যানে ৫, প্রাণিবিদ্যায় ২৫, ব্যবস্থাপনায় ৩৮, ভূগোলে ৭, মনোবিজ্ঞানে ৭, রসায়নে ২০, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৫৩, সমাজকর্মে ১৫, সমাজবিজ্ঞানে ১২ ও হিসাববিজ্ঞানে ৩৭ জন। আগামী ডিসেম্বরে এই শিক্ষকদের পদোন্নতি দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, বর্তমানে এ শিক্ষকদের এসিআর রেটিংয়ের কাজ চলছে।
শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা জানান, বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি দেওয়ার কারণে এই ক্যাডারে পদোন্নতি প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর। এ ক্যাডারে একটানা ১৭ বছর প্রভাষক পদে চাকরি করার নজিরও রয়েছে। এই কর্মকর্তা অধ্যাপক নোমান উর রশীদ পরে মাউশির মহাপরিচালকও হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার পদে রয়েছেন। কর্মকর্তারা চান, বৈষম্য নিরসনে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি চালু হোক।
এ ব্যাপারে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন,’বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা যোগ্যতা অর্জন করে বসে থাকলেও তাদের অধ্যাপক করা যাচ্ছে না। কারণ, পদ শূন্য নেই। গত বছর একবার পদ ছাড়াই পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এখন আমরা পদ সোপান তৈরি করছি। তিন বছর ধরে প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের বেশকিছু পদ সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা হলে সব সমস্যা কেটে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘পদ শূন্য নেই বলেই পদোন্নতির গতি শ্নথ।’
‘শিক্ষা’ সিভিল সার্ভিসের অন্যতম বড় একটি ক্যাডার। মাউশির সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) একেএম মাসুদ জানান, বর্তমানে এই ক্যাডারে ১৫ হাজার ৬৩৪ কর্মকর্তা কর্মরত। সারাদেশের ৩২৯টি সরকারি কলেজের পাশাপাশি শিক্ষা বোর্ড, পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন প্রকল্পে তারা প্রেষণেও কাজ করেন। এই ক্যাডারে মোট পদ ১৭ হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার ৮৯২টি পদ বর্তমানে শূন্য রয়েছে।
একাধিক কর্মকর্তা বলেন, পদ সৃষ্টি না হওয়ায় এ ক্যাডারে পদোন্নতির গতি খুব শ্নথ। ওপরের দিকে পদস্বল্পতার অজুহাতে বঞ্চিত করে রাখা হচ্ছে শিক্ষা ক্যাডারের হাজার হাজার কর্মকর্তাকে। অথচ প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডারে পদ না থাকা সত্ত্বেও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির দাবি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা। সূত্র: সমকাল