বিশেষ ফিচার: ঢাকা সহ গোটা বাংলাদেশ যখন ডেঙ্গুর প্রকোপে ভুগছে, তখন কলকাতা শহরে ডেঙ্গু গত কয়েকবছর ধরেই নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে।
কলকাতা কর্পোরেশন বলছে, তারা সারা বছর ধরে নিবিড় নজরদারি চালায় – যাতে কোথাও জল না জমে থাকে।
এর জন্য বহু কর্মীও যেমন রয়েছেন, তেমনই এবার এ কাজে আকাশে ওড়ানো হবে ড্রোনও।
অন্যদিকে শহরের প্রতিটা হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা পরীক্ষাগারে রোগীদের কী কী রক্ত পরীক্ষা হচ্ছে, কী ভাইরাস পাওয়া যাচ্ছে, তার প্রতিদিনের হিসাব রাখা হয়, যাতে ডেঙ্গু রোগীর খোঁজ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
তবে একটা সময়ে ছিল যখন বর্ষা শুরু হলে কলকাতা কর্পোরেশন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে নামতো। কিন্তু ততদিনে জীবাণু ছড়িয়ে পড়ত শহরের নানা অঞ্চলে।
কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতা কর্পোরেশন সারা বছর ধরেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কাজ করতে শুরু করেছে।
কলকাতার ডেপুটি মেয়র ও স্বাস্থ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ বলছিলেন, তারা কয়েকটা স্তরে বছরভর নজরদারি চালান। “প্রথমত, ১৪৪ টা ওয়ার্ডের প্রতিটাতেই আমাদের ২০ থেকে ২৫ জন করে কর্মী আছেন, যাদের মধ্যে একদল প্রচারের কাজ চালায়, আর অন্য দল জল জমছে কী না কোথাও, সেটার ওপরে নজর রাখে।”
“এর ওপরে আছে ১৬টি বরোর প্রত্যেকটার জন্য একটা করে র্যাপিড অ্যাকশন টীম। তাতে ৮ থেকে ১০ জন লোক থাকে সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে, গাড়িও থাকে তাদের কাছে। কোনও জায়গায় ডেঙ্গুর খবর পাওয়া গেলে অতি দ্রুত তারা সেখানে পৌঁছিয়ে এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণের কাজ করে”, – বলছিলেন মি. ঘোষ।
নজরদারী চললেও এখনও অনেক বহুতল বা সরকারি ভবনের আনাচে কানাচে জল জমে থাকতে দেখা যায় – যেগুলি ডেঙ্গুর রোগবাহী মশা এডিস ইজিপ্টাই জন্মানোর আদর্শ জায়গা।
যেসব জায়গায় জল জমে থাকতে দেখছে কর্পোরেশনের নজরদারী কর্মীরা, সেই ভবনগুলির ওপরে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ধার্য করার জন্য আইন পরিবর্তন করা হয়েছে।
আবার জল পরিষ্কার করে দেওয়ার খরচ বাবদ বিল, বাড়ির বার্ষিক করের বিলের সঙ্গে পাঠিয়ে দিচ্ছে কর্পোরেশন।
নজরদারি আরও ভালো করে চালানোর জন্য এবার আকাশে ড্রোন ওড়ানোর পরিকল্পনা হচ্ছে, যা থেকে মশা মারার তেলও ছড়ানো যাবে।
রোগ চিহ্নিতকরণ আর চিকিৎসার ব্যবস্থাও গড়ে তুলেছে কর্পোরেশন শহরের ১৪৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে।
ঘোষ বলছিলেন, “ভারতের বেশীরভাগ ল্যাবরেটারিই এখনও বেসরকারি। তাদের কাছ থেকে ঠিকমতো তথ্য কখনই পাওয়া যায় না। তাই বোঝা যাচ্ছিল না যে কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার বা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আমরা এই সমস্যা কাটানোর জন্য ১৪৪টা ওয়ার্ডেই একজন করে কর্মী রেখেছি, যার একমাত্র কাজ হল ওই এলাকায় যত হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে, সেখানে একটা খাতা নিয়ে হাজির হবেন।”
“কত রোগীর রক্ত পরীক্ষা হলো, কী কী পরীক্ষা হলো, পরীক্ষার ফল কী, সেগুলো নোট করে আনবেন তারা। সঙ্গে সঙ্গেই সেই তথ্য অনলাইন ব্যবস্থার মাধ্যমে পৌঁছিয়ে যায় বরো ভিত্তিক মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ টীমের কাছে।
এত ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও কোলকাতা শহরে ডেঙ্গু যে হয় না, বা তা থেকে যে মৃত্যু হচ্ছে না, তা নয়।
শহরের বেশ কয়েকটি নামী হাসপাতাল থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে পাওয়া তথ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু কর্পোরেশন ডেঙ্গুতে মৃত্যুর তথ্য চেপে যায় বলে অভিযোগ ওঠে নানা মহল থেকে।
অতীন ঘোষ অবশ্য বলছিলেন, “ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে কী না, সেটা বলার কোনও অধিকারই নেই কর্পোরেশনের। সরকারের একটা ডেথ অডিট কমিটি আছে।”
“কারও ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে, এটা জানা গেলে সব তথ্য ওই কমিটির কাছে পাঠাতে হয়। সেখানে শহরের নানা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আছেন। তারাই সিদ্ধান্ত নেন মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে না কী অন্য কোনও কারণে।”
বাংলাদেশের নানা জায়গায় যে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে, সেকথা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছেন ঘোষ।
“এটা আমাদের কাছে একটা চিন্তার কারণ। বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ কলকাতায় আসেন। তাদের মধ্যে কেউ যদি ডেঙ্গুর ভাইরাস নিয়ে আসেন, তা থেকে এখানেও রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা তৈরী হয়। তাই বাংলাদেশ চাইলে আমরা যে কোনও ভাবে সহায়তা করতে রাজী।”
“ওখানকার কোনও পৌরসভা যদি আমাদের কাছে সাহায্য চায়, তাহলে আমরা তাদের গিয়ে হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়ে আসতে পারি কীভাবে বছরভর আমরা ডেঙ্গু নিয়্ন্ত্রণের কাজটা করি,” – বলছিলেন কলকাতার ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষ। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন অবলম্বনে।