নিজস্ব প্রতিনিধি : আবারও যদি ছাত্রত্ব পেতাম তাহলে ভর্তি হতাম ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে। সেদিনের আনন্দ বিষাদের ঘটনাগুলি আবারও ভাগাভাগি করে নিতাম। কারণ স্টার নম্বর পেয়ে অনেক বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়া যায়, কিন্তু ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হলে ভাগ্য লাগে। ক’জনের হয় এই ভাগ্য।
শুক্রবার রাতে শ্রাবণধারার মধ্যে পুরনো দিনের এমনসব স্মৃতিকথা উঠে এলো বক্তাদের মুখ থেকে। তারা সবাই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অ্যালামনাই। ঈদ পুনর্মিলনী উপলক্ষে তারা সবাই সমবেত হয়েছিলেন সাতক্ষীরা শহরের অদূরে তুফান কনভেনশন সেন্টারে। সেখানে যেনো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ফেলে আসা দিনগুলি নিয়ে বীর দর্পে হাজির হয়েছিল অ্যালামনাইদের কথায় তাদের ভাষায় বচনে ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এসোসিয়েশন সাতক্ষীরার সভাপতি প্রফেসর আব্দুল হামিদ। অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অ্যালামনাই জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান, জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল, প্রবীণ আইনজীবী একেএম শহীদউল্লাহ প্রমূখ গুনি অ্যালামনাই তাদের জীবনকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় পরিবারের সাথে মিলিয়ে নিয়ে বলেন সেদিনের সব স্মৃতিই মিষ্টি মধুর। এখনও ঢাবিতে গেলে নিজের হলের দিকে ছুটে যাই। টিএসসিতে আড্ডা দেই। এখনও মনে জাগে প্রেম ভালবাসার কথা। কোন সব মেয়েকে ভালবাসতাম,ভালো লাগতো তাদের কথা। মনে পড়ে শিক্ষকদের কথা। যারা নিজেদের পান্ডিত্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন আমাদের জীবনে। সেইসব শিক্ষককে যদি পেতাম , আর যদি তাদের ক্লাসের একজন ছাত্র হতাম। এখনও স্মৃতিতে ভেসে ওঠে হলে সিট পাওয়া না পাওয়া, বিতাড়িত হওয়া না হওয়া এমনকি পুলিশের বুটের আওয়াজে টেবিল ও খাটের নিচে অথবা ড্রেনের মুখে পালিয়ে থাকার কাহিনী।
স্মৃতি চারনকালে তারা বলেন ঢাবিতে পড়াকালিন কেউ কেউ মুখোমুখি হয়েছেন ১৯৮৫ এর অক্টোবরের জগন্নাথ হল ট্রাজেডির, মহসিন হলের সেভেন মার্ডারের তিক্ত স্মৃতি ও ১৫ আগস্ট সপরিবারের বঙ্গবন্ধু হত্যার নৃশংসতম ঘটনার। বলেন দেখেছি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মিলিটারিদের বুটের আওয়াজ। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, গণতান্ত্রিক সকল সংগ্রাম, বাংলাদেশের স্বাধীনতা , ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন , স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম সব কিছুরই সূতিকাগার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় আমাদের জীবনের সূচনা করে দিয়েছে। জাতিকে দিক নির্দেশনা দিয়েছে। সঠিক পথের সন্ধান দিয়েছে।
স্মৃতিচারণ পর্বে জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন এড. অরুণ ব্যানার্জি, শিক্ষক অলোক কুমার, রাজনীতিক ফিরোজ কামাল শুভ্র, ব্যাংক কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান, ব্যাংক কর্মকর্তা মো. শহিদুর রহমান, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নাজমুননাহার, কলেজ শিক্ষক মো. শরিফুল আলম, প্রভাষক আকবর হোসেন, ঢাবি শিক্ষক ড. সাইফুল ইসলাম, কলারোয়া সরকারি কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর আনোয়ারুজ্জামান মুকুল, ঝিনাইদহ সরকারি লালন শাহ কলেজের অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমান, কলেজ শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম,শিক্ষা অফিসার মো. নজরুল ইসলাম, শেখ রেফাজুর রহমান বিমান, স্কুল শিক্ষক মো. আবুল হাসান, কলেজ শিক্ষক মন্ময় মনির প্রমূখ।
জাতির সকল চরিত্রের ধারক বাহক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে উল্লেখ করে তারা বলেন এখন ডেঙ্গুরোধে আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে। সমাজের অনিয়ম দুর্নীতি বিশৃংখলারোধে এবং মাদক সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত সমাজ গঠনে ঢাবি ছাত্ররা বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারে।
অনুষ্ঠান চলমান অবস্থায় ঢাকায় অবস্থানরত ঢাবি’র অ্যালামনাই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান ডা. আফম রুহুল হক এমপি ভিডিও কনফারেন্সে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন ঢাবি ছাত্ররা সমাজকে আলোকিত করতে জানে। পেশাগত জীবনে এসে তাদের এই দায়িত্ব আবারও নিতে হবে।
ঢাবি বিশ^বিদ্যালয় হলে ছারপোকার কামড়ের কথা স্মৃতিতে এনে বক্তারা বলেন তারা পালা করে বিভিন্ন হলে খেতেন। ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটেনা, অন্যের জন্য সে নিজেকে বিকশিত করে’ উল্লেখ করে অ্যালামনাইরা বলেন ঢাবি আমাদের সাহিত্য ও বিজ্ঞান চর্চা শিখিয়েছে। শিক্ষকতা শিখিয়েছে, আমাদের আইন শিখিয়েছে, বিচার করা শিখিয়েছে। সামাজিক ও মানবিক গুনাবলী শিখিয়েছে। সভ্যতা শিখিয়েছে। জীবনকে গড়তে শিক্ষা দিয়েছে। মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছে। নতুন নতুন স্বপ্ন বাস্তবায়নে উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়। আলোকিত সমাজ গঠন করা শিখিয়েছে। এই শিক্ষা এখন পেশাগত জীবনে এসে ছড়িয়ে দিতে হবে। আবেগে আপ্লুত হয়ে অ্যালামনাইরা বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা উচ্চারন করে বলেন ‘ আবার যদি দেখা হলো, সখা, প্রাণের মাঝে আয়’।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অ্যালামনাই এসোসিয়েশন সাতক্ষীরার সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক হাফিজুর রহমান মাসুম এবং এসোসিয়েশনে সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ জাফরুল আলম বাবু’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, নিজেকে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করি। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াকালিন যে তারুণ্য ছিল আজও টিএসসিতে গেলে সেই তারুণ্যের অনুভব পাই। তিনি ঢাবি অ্যালামনাই এসএম হলের প্রয়াত নজরুল ইসলামের মাকে এককালিন ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষনা দিয়ে বলেন তিনি যাতে বাকি জীবন কোনো কষ্ট ছাড়াই কাটাতে পারেন সেজন্য তাকে সবাই মিলে আরও সহায়তা দেওয়া হবে। সাতক্ষীরার উন্নয়নে অনেক পিছিয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন সাতক্ষীরার অ্যালামনাইরা তাদের জেলার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখতে পারেন। তিনি বলেন সাতক্ষীরার প্রাণ সায়ের খাল হবে নান্দনিক, পাঁচটি নদী খনন করা হবে এভাবেই সুন্দর পরিবেশ এই জেলার সন্তানদের উপহার দিতে চাই। তিনি এই কাজে ঢাবি অ্যালামনাইদের সহযোগিতা কামনা করেন। বৈশি^ক উষ্ণতা ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন ডেঙ্গুরোধে সবাইকে কাজ করতে হবে।
স্মৃতিচারণ পর্বের সভাপতি সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান বলেন, আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রেমে পড়েছি। ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য ঢাবির মজ্জার সাথে মিশে আছে’ আহমেদ ছফার এই বাক্য উচ্চারণ করে তিনি বলেন বাংলাদেশ বিনির্মানে ঢাবি অ্যালামনাইরা কাজ করতে পারেন। ঢাবির চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিদের অধিকার আদায় আন্দোলনে সমর্থন দেওয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব চলে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন এটি আমাদের জাতির পিতার বীরত্বের ইতিহাস। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভেতরের যতো উন্নয়ন হোক এর কাঠামোগত উন্নয়ন তেমনটি হচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন এখন হলের এক কক্ষে ১২/১৪ জন ছাত্র বাস করে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।
তিনি বলেন স্মৃতি কথা কখনও মুছে যায়না, স্মৃতি কথা মলিন হয়না। শুধু স্মৃতিতে ধুলো জমে। এই স্মৃতিকে ধরে রেখে তিনি বলেন ঢাবিতে লেখাপড়া শেষ করেও যেনো আবারও ছাত্র হতে ইচ্ছা জাগে। তাই ‘শেষ হয়েও হইলো না শেষ’।
এই পর্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, পুনর্মিলনী ২০১৯ আয়োজক কমিটির আহবায়ক সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক আবুল হাসান ও সদস্য সচিব অধ্যাপক আকবর হোসেন। স্মৃতিচারণ ও আলোচনা শেষে উপস্থিত অ্যালামনাইদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর অনুষ্ঠিত হয় র্যাফেল ড্র।
অনুষ্ঠানের শেষে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র মরহুম নজরুলের অসহায় মায়ের হাতে এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ৬ হাজার টাকা প্রাথমিক সাহায্য হিসেবে তুলে দেন সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ শেখ মফিজুর রহমান।
সাতক্ষীরায় ঢাবি’র প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের আবেগঘন মিলনমেলা
পূর্ববর্তী পোস্ট