বিশেষ প্রতিবেদন: দেশের দুই লাখ ৪৫ হাজার ৫১৬ জন মানুষের জন্য লবণাক্ততামুক্ত ও দুর্যোগ সহনশীল সুপেয় পানি নিশ্চিত করছে সরকার। বছরব্যাপী এই সুবিধা পাবেন খুলনা ও সাতক্ষীরার ৩৯টি ইউনিয়নের ৫৫ হাজার পরিবারের এই আড়াই লাখ মানুষ। এর জন্য খরচ হবে প্রায় ২৭৭ কোটি টাকা। একই সঙ্গে সরকার ওই অঞ্চলের ৪৩ হাজার পরিবারের নারী সদস্যদের জন্য জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকার সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে অভিযোজন সক্ষমতা গড়ে তুলতে চায়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। ‘উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর, বিশেষত নারীদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততা মোকাবেলায় অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। মহিলা বিষয়ক অধিদফতর এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন, কয়রা উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন, পাইকগাছা উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন এবং সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন, শ্যামনগর উপজেলার আটটি ইউনিয়নসহ মোট ৩৯টি ইউনিয়নের ৫৫ হাজার পরিবারের আড়াই লাখ মানুষ সারা বছরই সুপেয় পানি পাবেন।
পাশাপাশি খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার পাঁচটি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়নের ৪৩ হাজার পরিবারের নারী সদস্যদের জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকার সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও বিপণন ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে অভিযোজন সক্ষমতা গড়ে তোলা হবে। এই ৩৯টি ইউনিয়নে ১০১টি নারী স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা হবে। প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহায়তার মাধ্যমে নারী সংবেদনশীল পূর্ব সতর্কীকরণ ও দুর্যোগ প্রস্তুতি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। মহিলা বিষয়ক অধিদফতর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জলবায়ু অভিযোজন বিষয়ক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রায়োগিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো হবে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ২৭৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে ৬৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর বৈদেশিক সহায়তা বাবদ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড থেকে পাওয়া যাবে ২০৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
পরিকল্পনা মন্ত্রলণালয় সূত্র আরও জানান, প্রকল্পের আওতায় উপকূলীয় কৃষিজীবী জনগোষ্ঠী বিশেষত নারীদের জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকায়নে অভিযোজন দক্ষতা বাড়ানো হবে। ৪৩ হাজার নারীকে জীবিকা সহায়তা দেওয়া হবে। এ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও উপকরণ দেওয়া হবে। কাঁকড়া চাষ, গৃহস্থালী পর্যায়ে সবজি চাষ, তিল চাষ, লবণাক্ততা সহিষ্ণু নার্সারি এবং বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন শেখানো হবে। কমিউনিটিভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরি হবে। বাজারজাতকরণ এবং সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের জন্য সহযোগিতা করা হবে। সমাজভিত্তিক মনিটরিং এর ব্যবস্থা করা হবে।
সুপেয় পানির ব্যবস্থার লক্ষ্যে নলকূপ স্থাপনের জন্য নির্দিষ্ট সাইট ম্যাপিং, উপকারভোগী নির্বাচন এবং কমিউনিটি ব্যবস্থাপনা কাঠামো গঠন করা হবে। ১৩ হাজার ৩০৮ পরিবারের জন্য বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং এই পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকবে। ৪১টি পুকুরভিত্তিক পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জীবিকায়ন এবং নিরাপদ খাবার পানি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানো হবে। উপকূলীয় জীবনযাত্রা এবং জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকা সম্পর্কিত নারী-পুরুষ সাম্যতার প্রতি সংবেদনশীল কৌশল প্রণয়নে মহিলা বিষয়ক অধিদফতর এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও সমন্বয় দক্ষতা শক্তিশালীকরণের কাজ করা হবে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার জানিয়েছেন, ‘প্রস্তাবিত প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর বিশেষত নারীদের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়াতে লবণাক্ততা সহিষ্ণু জীবিকা, পানীয় জলের নিরাপত্তা বিধান করা, যা বাংলাদেশ সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
তিনি জানান, ‘এ প্রকল্প স্থানীয় পর্যায়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদকে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে এক হাজার ১১৮টি দলগঠন ও বিভিন্ন সংগঠনমহ স্থানীয় পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বাড়াবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দারিদ্র্য নিরসন কৌশল প্রণয়নে দরিদ্র, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অভিঘাত প্রতিরোধ ও ঝুঁকি হ্রাসের উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।’
সচিব জানান, ‘এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৩ হাজার দরিদ্র নারীকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজ হবে। ৪৩ হাজার নারীকে জীবিকা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে এ প্রকল্প এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে।’
তিনি আরও জানান, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নোনা উপদ্রুত উপকূলীয় অঞ্চল হিসেবে ছয়টি জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। জেলাগুলো হল সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা। এসব জেলায় জীবন-জীবিকার উন্নয়নে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কর্মসূচি গ্রহণ করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পটি লবণাক্ততা সহিষ্ণু জীবিকায়ন ও নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে সরকারের উদ্যোগকে আরও শক্তিশালী করবে। পান করার জন্য এবং গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের জন্য নিরাপদ পানির সহজ প্রাপ্তি নারীর ক্ষমতায়নকে প্রশস্ত করে। এতে তাদের যে সময় বেঁচে যায় সেই সময় তারা অন্য কোনও উৎপাদনমুখী কাজে ব্যয় করতে পারবেন। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বাড়বে। প্রকল্পটি ১৩ হাজার ৩০৮ টি পরিবারভিত্তিক, ২১৮টি কমিউনিটিভিত্তিক এবং ১৯টি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ প্ল্যান্ট স্থাপন এবং ৪১টি পুকুরভিত্তিক পানি শোধনাগার স্থাপনের মাধ্যমে সরকারের কর্মকৌশল বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বসবাসরত বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর, বিশেষ করে নারীদের জলবায়ু পরিবর্তন সৃষ্ট লবণাক্ততার ঝুঁকি প্রশমন ও অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা এবং জীবিকার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে। এসব কারণেই এ প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন করা হয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্প শতভাগ বাস্তবায়ন হবে।’