জঙ্গিদের সাম্প্রতিক তৎপরতা ও আত্মঘাতী হামলা নিয়ে চিন্তিত সরকার। দলীয় কর্মসূচিতে হামলা হতে পারে—এমন আশঙ্কায় সরকারি দলের জেলা পর্যায়ের নেতাদের সতর্ক করা হয়েছে।
সরকার ও আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা গেছে। সূত্রগুলো জানায়, সরকারের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, বড় অঘটন ঘটিয়ে আলোচনার জন্ম দেওয়াই জঙ্গিদের মূল লক্ষ্য। এ অবস্থায় কম সময়ে এবং কম ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি চায় সরকার।
দলীয় সূত্র জানায়, শনিবার রাতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের সময় সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একজন কর্মকর্তা সাংগঠনিক সম্পাদকদের এই সতর্কতার কথা জানান। বিশেষ করে স্বাধীনতা দিবসের সভা, সমাবেশ ও শোভাযাত্রায় বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়।
গতকাল রোববার তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদক এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আওয়ামী লীগের স্বার্থের ওপর হামলা হতে পারে—এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে এই নির্দেশনা এসেছে। তাঁদের অধীন জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের শনিবার রাতেই ফোন করে এই নির্দেশনা জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই তিন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, তাঁদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, দলীয় কর্মসূচিতে কেউ ব্যাগ বা সন্দেহজনক কিছু বহন করছেন কি না, কোনো ব্যক্তিকে স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে বাড়তি কিছু শরীরে জড়িয়ে রেখেছেন কি না, এসব দিকে নজর রাখতে। প্রয়োজনে অনানুষ্ঠানিকভাবে দলীয় লোক দিয়ে কমিটি করা যেতে পারে।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুটি জেলার নেতারা এই সতর্কবার্তা পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন।
একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, সাধারণত শীর্ষ নেতা বা মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে হওয়া অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা থাকে। এর বাইরে যেসব দলীয় কর্মসূচি হয়, সেগুলোতেই মূলত নিজ উদ্যোগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, গত কয়েক বছরের জঙ্গি হামলা ও বেছে বেছে হত্যার ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। ঘটনাগুলো টানা ঘটতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় আবার স্তিমিত হয়ে পড়ে। সরকার কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক খবর কমে আসে। এরপরই আবার একটা ঘটনা ঘটে যায়। এবার এই ধাক্কা কত দিন সামলাতে হয় এবং এর ক্ষয়ক্ষতি কতটা দাঁড়ায়—এটাই এখন সরকারের মূল ভাবনার বিষয়।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক ঘটনার পেছনে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের প্রভাবের পাশাপাশি বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করার দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, সে সন্দেহও সরকারের উচ্চপর্যায়ে রয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল বলেন, ‘জঙ্গি তৎপরতা আমরা নির্মূল করতে পারিনি। তবে তাদের দমন করা গেছে। তারা সংখ্যায় খুব বেশি না। আতঙ্ক সৃষ্টি করাই তাদের মূল লক্ষ্য।’ তিনি বলেন, পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণেই আছে। জঙ্গিরা জয়ী হতে পারবে না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘মুশকিলটা হচ্ছে, দেশি-বিদেশি একটা ষড়যন্ত্রকারী মহল তাদের (জঙ্গিদের) আর্থিক সহায়তা ও মদদ দিচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করে অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করতে চায়। সরকার এই বিষয়ে সচেতন।’
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটনে সরকারের বিভিন্ন বাহিনী সক্রিয় আছে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে মানুষকে সংগঠিত করার কাজটা এগোচ্ছে না। হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর সরকারি উদ্যোগে সারা দেশে সর্বদলীয় কমিটি করার জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু মাঝে জঙ্গি তৎপরতা কমে যাওয়ার পর ওই কমিটিগুলো স্থবির হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটেও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার বিষয়ে একাধিকবার আলোচনা হয়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কিছু সভা-সমাবেশও করা হয়। কিন্তু লাগাতার কর্মসূচি ছিল না। অর্থাৎ বিষয়টিকে দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচির আওতায় এনে জোরদারভাবে তা চালিয়ে নেওয়ার কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গতকাল বলেন, এই জঙ্গিরা সুপ্ত ছিল, ঘাপটি মেরে ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় ধরা পড়ছে। আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল রাজনৈতিকভাবে সোচ্চার। মানুষও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। জঙ্গিরা সফল হবে না। সাময়িক আতঙ্ক সৃষ্টি করে দেশের সুনাম কিছুটা নষ্ট করতে পারবে।