মো. বশির আহমেদ: স্বাধীনতার আগে থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও পর্যন্ত প্রভাব রেখে যাওয়া রাজনীতিবিদের অন্যতম ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রাজনীতিক হিসেবে সর্বশেষ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য পদে থাকলেও দীর্ঘ কেরিয়ারে ছিলেন নানা ভূমিকায়।
সুপরিচিত এই রাজনীতিবিদের জন্ম ১৯৪৫ সালে ৫ মে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। তার পিতার নাম দেবেন্দ্র নাথ সেনগুপ্ত এবং মাতার নাম সুমতিবালা সেনগুপ্ত৷
প্রবীণ এ সাংসদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। পরে সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে এলএলবি ডিগ্রি সম্পন্ন করে আইন পেশায় নিযুক্ত হন। এছাড়াও তিনি বাংলা, ইংরেজি, সংস্কৃত, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন৷
ছাত্র জীবনেই তিনি বামপন্থী রাজনীতির মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। হাওরাঞ্চলের ‘জাল যার জলা তার’ আন্দোলনে দীর্ঘদিন তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭০ সালের পাকিস্তান নির্বাচনে তিনি সিলেট জেলা থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির পক্ষ থেকে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম জাতীয় সংসদসহ মোট সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন । মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোয়ারের সময়েও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে মাত্র ২৫ বছর বয়সে নির্বাচিত হয়েছিলেন এই রাজনীতিবিদ।
বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধান পরিষদে তিনি বিরোধী বেঞ্চের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এরপর তিনি নিজে একতা পার্টি নামক একটি দল গঠন করেন। ১৯৯০ এর দশকে তিনি আওয়ামী লীগ এ যোগদান করেন। এর আগে তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত একতা পার্টির সাথে জড়িত ছিলেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে বিশেষ ক্ষমতার অধীনে পুলিশ তার বাসায় তল্লাশী চালালে তাকে ধরতে অসমর্থ হয়। তিনি ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রেলমন্ত্রী নিযুক্ত হন। যদিও সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির ঘটনার পর তিনি পদত্যাগ করেন। তবে প্রধানমন্ত্রী সেই পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিপরিষদে রাখেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সংসদে সব সময় সরব এ সংসদ সদস্য একজন অভিজ্ঞ সংবিধান বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশ গ্রহণ করা এই রাজনীতিকের একটি অন্যতম পরিচয় ছিল সংবিধান এবং আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির একজন কনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন তিনি।
অভিজ্ঞ এই রাজনীতিবিদ মানুষের মাঝে বেশি পরিচিত ছিলেন সংসদে তার চাতুর্যপূর্ণ এবং রসাত্মক বক্তব্যের জন্য। রাজনীতিবিদ হিসেবে বিপক্ষের নেতাদেরও সমীহ পেয়েছেন তিনি।
জাতীয় সংসদে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ এবং সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক এবং একে অপরকে কটাক্ষ করার ঘটনা ঘটনা ঘটেছে বহুবার।
“আমরা একই দলে কখনো কাজ করিনি, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্ব থেকে গেছে। সত্যিকার অর্থে রাজনীতিবিদ বলতে যেটা বোঝায়, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সেই রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় প্রতিটি সংসদে তিনি ছিলেন, এটিই প্রমাণ করে যে তিনি একজন জনপ্রিয় একজন জাতীয় নেতা ছিলেন”। ‘বন্ধু সুরঞ্জিতের’ মৃত্যুর পর প্রতিক্রিয়ায় বলেন মি. আহমেদ।
সে সময় থেকে দীর্ঘদিন একসাথে রাজনীতি করেছেন বামপন্থী নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য। তিনি বলছিলেন, সে সময় নাট্য-অভিনেতা হিসেবেও খ্যাতি ছিল মি. সেনগুপ্তের।
“হলগুলোর নাটকের প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ নাটকে সুরঞ্জিত অভিনয় করেছিল একাধিকবার। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, অভিনেতা থেকে নেতা হয়ে গেছো তুমি”। পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষায় সবসময়ই বড় ভূমিকা রেখেছেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন “তিনি যখন পার্লামেন্টে বক্তৃতা করতেন, সকল সদস্য সেটা তন্ময় হয়ে শুনতেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নাম সব সময় লেখা থাকবে। একজন মহান নেতাকে আমরা হারালাম, তার শূন্যতা পূরণ হওয়া অত সহজ নয়”,
ফুসফুসের সমস্যার জন্য ২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি তাকে ঢাকার ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি করা হলে ৪ তারিখ রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় প্রথমে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ও পরে লাইফ সাপোর্টে দেয়া হলেও ৫ ফেব্রুয়ারি রোববার ভোর রাত ৪টা ২৪ মিনিটে ৭১ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন৷ তার নির্বাচনী এলাকা সুনামগঞ্জের দিরাইতে শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। তিনি স্ত্রী ও এক সন্তান রেখে গেছেন।
বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মরদেহে ফুল দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদেরা।
পূর্ববর্তী পোস্ট