বাংলাদেশের ‘অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের’ জন্যে ব্যবসা বাণিজ্য গণপরিবহন চালু করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এই বিষয়ে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি সরকার নিয়োগ দিয়েছে তাঁদের পরামর্শ ছিলো উল্টো আরো বেশি কঠোর ব্যবস্থা।
যারা সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন তাঁদের বক্তব্য সহজ মানুষকে বাঁচাতে হবে, জীবিকা ছাড়া মানুষ বাঁচবে না। এতদিন ধরে এত রকম সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কথা বলা হল, দরিদ্রদের অর্থ দেয়ার কথা বলা হল, ত্রাণ বা উপহার হিসেবে খাদ্য দেয়ার কথা বলা হল তা যে মানুষের বিশেষত সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের জীবন রক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি সেটাই আসলে স্বীকার করে নেয়া হল।
এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যারা কথা বলেন তাঁদের সুর একই রকম- সব তো সারা জীবন বন্ধ রাখা যাবে না, যেন এমন কোন পরামর্শ কেউ কখনো দিয়েছিলো। কিন্ত কী বিবেচনায় এখন খোলা হচ্ছে তা কারো জানা আছে বলে মনে হয় না। সহজ করে বললে – কোন কৌশল তৈরি হয়নি। কিন্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
ভাইরাস কতটা নিয়ন্ত্রণে এলে কী খোলা হবে তা নিয়ে কোনও রকম সুস্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছিলো কি? ‘সীমিত’-এর পরিমাপ কে করে? কেউ যদি গত দুই দিনের অভিজ্ঞতায় বলেন যে, ছুটি শেষ করা হচ্ছে এক শ্রেণীর মানুষের বিদেশ যাত্রার পথ সুগম করতে তা হলে কি অন্যায় বলা হবে?
এই সংকটে প্রথমে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা দেখা গেলো। মানুষ চিকিৎসা পায় না, এমনকি তাঁরা আক্রান্ত কিনা তাও জানবার উপায় নেই। হাসপাতালের দরজায় লাইন দিয়ে অপেক্ষা করতে হয়, এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে হয়, হাসপাতালের লাইনে দাড়িয়েই মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। সন্তানসম্ভবাকে জনগণের অর্থে চলা হাসপাতাল চিকিৎসা দেয়নি, তাঁকে রাস্তার পাশে বসে থাকতে হয়েছে।
এগুলো নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভের পরে সেটাই স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া হল। উপসর্গে মারা যাওয়ার একটা হিসেব এতদিন পাওয়া যাচ্ছিলো, এখন তাও আর সহজে দৃশ্যমান নয়। কে কিভাবে মারা যাচ্ছেন তাতে কিছু আসে যায় না। ধনীদের জন্যে ঘোষণা দিয়ে আলাদা হাসপাতাল করার কথা উঠলো, শেষ পর্যন্ত আলাদা হাসপাতাল হয়নি, কিন্ত কার্যত আলাদা হাসপাতাল তৈরি হল। যারা তাতে সন্তষ্ট নন তারা এখন চার্টার বিমানে করে বিদেশে যাচ্ছেন।
গরীবের জন্যে, মধ্যবিত্তের জন্যে কী থাকলো? দেশে পরীক্ষার ক্যাপাসিটি প্রতিদিন ৩০ হাজার, কিন্ত তার অর্ধেকও কোনো দিন ব্যবহার হয়নি। ফলে দাড়ালো আপনার দায়িত্ব আপনার। সামাজিক মাধ্যমে এখন কেবল প্ল্যাজমা চেয়ে আবেদন দেখতে পাচ্ছি। যেন আপনার স্বজনের বাঁচাবার দায়িত্ব আপনার একার সরকার, রাষ্ট্র কোন দায়িত্ব নেবে না। বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই একটা কথা প্রায়শই বলা হয় ‘নিজে ঠিক থাকলে সব ঠিক’। অনাচার নিয়ে কথা বললেই বলা হয় – ‘দেশকে বদলাতে হলে আগে মানুষকে বদলাতে হবে’|
কেউ কেউ তো আরেক ধাপ এগিয়ে বলেন, ‘আসুন, নিজেকে বদলাই’| এসবের মূল কথা হচ্ছে নিজের দায়িত্ব নিজের। যা কিছু খারাপ তাঁর জন্যে আপনিই দায়ী। এখন যে সব কিছু করা হচ্ছে তার উদ্দেশ্যও তাই। বেঁচে থাকা, ভালো থাকা আপনার দায়িত্ব। আপনি যদি ‘জীবিকার’ সন্ধানে গিয়ে মারা যান, তবে সেই সিদ্ধান্ত আপনার দোষও আপনারই। তাহলে রাষ্ট্র, সরকার কী করবে?
এর উত্তর অজানা নয় অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হলে তাঁকে জামাই-আদরে দেশের বাইরে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। যারা নিজেরাই চার্টার প্লেন যোগাড় করতে পারবে তাঁদের জন্যে বিমান বন্দরের সুবিধা নিশ্চিত করবে।
লেখক: আলী রীয়াজ, ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, রাজনীতি ও সরকার বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।