একেকটা ঘটনা ঘটে, বিরাট হৈ চৈ হয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় বয়ে যায়, দুদিন পর সবই বরফ চাপা পড়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক জঘন্য থেকে জঘন্যতর ধর্ষণ আর খুনের ঘটনা ঘটছে। কেউ দোষ দিচ্ছি ভিক্টিমের, কেউ বা বাবা মায়ের, কেউ পোষাকের, কেউ অবাধ মেলামেশার। মাদ্রাসার ছাত্র অপরাধী হলে দোষ দিচ্ছি মাদ্রাসা শিক্ষার, ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র অপরাধী হলে দোষ দিচ্ছি ইংরেজি মাধ্যমের। কিন্তু দোষারোপের জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে ধর্ষণের মতো একটা কুৎসিত সামাজিক অপরাধ এই প্রযুক্তি এবং জীবন মানের উৎকর্ষতার সময়ে বাংলাদেশে একটা দানবাকৃতির সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে কেন সেটা ভেবেছি কি? এটা নিয়ে ভাববার, রীতিমতো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা এবং তার উপর ভিত্তি করে শুধু কিশোর যুবক নয় বরং প্রতিটা নাগরিককে সচেতন করা, প্রশিক্ষণ দেয়া এবং এর বিরুদ্ধে সংগঠিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার সময় এসেছে। এবং অবশ্যই এই সামাজিক আন্দোলনে সরকার, বিরোধীদল, ভাসমান মানুষ থেকে শুরু করে প্রতিটি শ্রেনী, পেশা, বয়সের মানুষের সমান অংশীদারিত্ব থাকবে, থাকতে হবে। প্রতিটা ঘটনা ভাবনার ভিন্ন ভিন্ন ডাইমেনশন ওপেন করে। একজনের সাথে আরেকজনের ভাবনা মেলে না। কিন্তু প্রতিটা ভাবনাকে জোড়া দিলে একটা প্যাটার্ন নিশ্চয়ই পাওয়া সম্ভব। এ জন্যই প্রয়োজন সামাজিক গবেষণা। জীবনের চার দশক ছুঁয়ে যখন ফিরে তাকাই পঁচিশ তিরিশ বছর পেছনে, আজকের মতো ভয়াবহ সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখি না। স্বাভাবিক ভাবে তখন মনে কিছু ভাবনা ও প্রশ্ন জাগে।
নব্বইয়ের দশকে কৈশোর কেটেছে সিলেট শহরে।পড়ালিখা করেছি কোন গার্লস স্কুলে নয়, বরং কো এডুকেশন ছিলো আমাদের শিক্ষার মাধ্যম। আজকের প্রজন্মের চেয়ে স্বাধীনতা কম ছিল না আমাদের। ছেলেদের ছেলে হিসেবে নয় সহপাঠী হিসেবে জেনেছি। তবে কি সেই আমলে কেউ কোনদিন ধর্ষণের শিকার হয়নি? অবশ্যই হয়েছে, ঘটেছে, তবে এমন বিস্তৃত পরিসরে নয়। চেনা গন্ডির মধ্যে এই শব্দ শুনিনি সহসা। যখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী আমি, তখন দৃষ্টিহীন দাদাকে সংবাদ পত্র পড়ে শোনাতে গিয়ে এই শব্দের সাথে পরিচয় আমার। তখনো এর মানেও জানতাম না। তার মানে কি সবাই চরম ভালো ছিলো, সবাই মহামানব ছিলো ! মানুষের রিপু বলে কিছুই ছিলো না? অবশ্যই বিচ্যুতি, স্খলন, অপরাধ প্রবণতা তখনো ছিলো। কিন্তু সেই সাথে ছিলো আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশী, শিক্ষক, এমনকি বিদ্যালয়ের আয়া, বুয়া, ঝাড়ুদার, চানাচুর বিক্রেতা মামা, পাড়ার দোকানদার থেকে পথচলতি পরিচিত মানুষের কড়া নজরদারি।পরিচিত গন্ডির অধিকাংশ মানুষ অভিভাবকের ভূমিকায় থাকতেন। আজকাল আমরা আধুনিক, তথাকথিত অতি সংবেদনশীল মানুষ। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার চর্চাটাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে গেছি, কারো ভালো কথা, ভালো উপদেশ শুনতে হলেও আমাদের অধিকাংশ মনে করি অনধিকার চর্চা করছে, প্রাইভেসি নষ্ট করছে। কয়জন আমরা বুকে হাত দিয়ে বলতি পারি, প্রতিবেশীর সাথে সেই সুসম্পর্ক আমরা রেখেছি বা গড়েছি যেখানে প্রতিবেশীর সন্তান আপনার সন্তানকে ভাই/প্রিয় বন্ধু মনে করে? আপনার অবর্তমানে আপনার ঘরে থাকা সন্তানদের নজরদারিতে রাখার অধিকার আছে আপনার প্রতিবেশীর অথবা বিল্ডিংয়ের নিরাপত্তা কর্মীর? যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার গড়েছি আমরা সময়ের প্রয়োজনে, সময়ের হাত ধরে। কিন্তু নিজেদের এবং নিজেদের সন্তানদের রক্ষাকবচ কোথায় আমাদের? শিক্ষা, বিশেষত একজন মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হবার শিক্ষা একটা শিশু পরিবার, প্রতিবেশ, বিদ্যালয়, সমাজ এবং রাষ্ট্রের হাত ধরে পায়। আর এই শিক্ষা দিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা সবাই চরম ব্যর্থ। আমরা ব্যক্তি স্বাতেন্ত্র্যর শিক্ষা দিতে দিতে আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা এবং পরিবারে, সামাজে বসবাস করতে গেলে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতা প্রয়োজন সেই শিক্ষা দিতে ভুলে গেছি। সামাজিক অনুশাসন, রীতি, শিষ্টাচারের পাঠ দিতে আমাদের অনেকেরই অনীহা। কথায় কথায় এখন বহু মানুষকে বলতে শুনি ‘সমাজ কি? সমাজ কে? সমাজকে গুরুত্ব দিতে হবে কেন?’। পড়তে গিয়ে, পড়াতে গিয়ে এবং জীবনে চলতে গিয়ে শুধু জেনেছি নয়, প্রতিটা সময় উপলব্ধি করি/করছি, বস্তুগত উন্নয়ন থেকে মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নের গতি অনেক ধীর, আমাদের দেশে এই বাস্তবতা আরো জটিল, গভীর। নগর সভ্যতার প্রসার ঘটেছে খুব দ্রুত লয়ে, কিন্তু এর উপজাত হিসেবে তৈরি হওয়া সমস্যাগুলো গুরুত্ব সহকারে আমলে নেয়নি কেউ, হয়নি যথেষ্ট গবেষণা, নেয়া হয়নি যথার্থ সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনা। মেট্রোপলিটন সিটির সোডিয়াম বাতির ঝলকানিতে বাঁচতে গিয়ে আপনার আমার সন্তানদের প্রযুক্তি, পুঁথিগত শিক্ষায় আধুনিক করছি, আধুনিকতর সুযোগ সুবিধা, খাবার থেকে শুরু করে আধুনিকতম জীবনযাপনে তাদের অভ্যস্ততা তৈরি করছি, মননে পারছি কি? ‘বয়সোচিত আচরণ’ ‘মানসিক স্বাস্থ্য/মানসিক সুস্থতা’ ‘নৈতিকতা’ এমনকি ‘যৌনতা’ এই বিষয়গুলো আমরা জাতিগত ভাবে কতটা ধারণ, লালন ও পরিচর্যা করি? প্রশ্নটা অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজ এবং রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে নিজেকেই আগে করি, সাথে আপনাদেরও করে যাই।
শাস্তির ভয় সব অপরাধ নির্মুল করতে পারে না, অপরাধের শেকড় খুঁজে বের করে সেটা উৎপাটন করতে হয়। গাছে ফুল, ফল ফোটাতে যেমন সার, পানি, যত্ন লাগে; ঠিক তেমনি ‘প্রকৃত সংবেদনশীল, বিবেক সম্পন্ন, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ’ এমনি তৈরি হয় না, নিবিড় পরিচর্যা লাগে, সঠিক দিক নির্দেশনা লাগে। মমতা, শাসন, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে দৃঢ় হোক পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন।
বি: দ্র: এটা কোন আদর্শ, পরিপূর্ণ আলোচনা নয়।একটা ব্যক্তিগত ভাবনা তুলে ধরার অতি ক্ষুদ্র চেষ্টা। আমি জানতে চাই, বুঝতে চাই, ভাবতে চাই। আপনাদের সমালোচনা এবং ভাবনা থেকে রসদ নিয়ে নিজের সন্তানদের মানুষ করতে চাই, নিজের এবং তাদের ভাবনার জগত আলোকিত করতে চাই। এক কথায় যে কোন ভাবনাকে সম্পূর্ণ সঠিক বা সম্পূর্ণ ভুল বলতে শিখিনি আমি। বাস্তবতা প্রতিটি সমাজ ও রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষিতে ভিন্ন থেকে ভিন্নতর। ভাবনাগুলোও তাই। এই লিখার উদ্দেশ্য কোন ভাবেই এটা বলা নয় যে সামাজিক সব অনুশাসন শতভাগ সঠিক। সমাজ যেমন গতিশীল, পরিবর্তনশীল এর নিয়মনীতি ও আদর্শও ব্যতিক্রম নয়। তবে সামাজিক শৃঙ্খলাকে ধারন, লালন এবং পরিচর্যা করার কোন বিকল্প নেই। সমাজের অংশীদার হিসেবে সমাজের ন্যায়সঙ্গত পরিবর্তনের অধিকার আপনার আমার আছে। বেগম রোকেয়া, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায় কিন্তু সেটাই করেছিলেন। সমাজকে অস্বীকার করেননি।
- সোনিয়া চৌধুরী – শিক্ষক