পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য শুক্রবার দুপুরে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। সাথে ছিল আমার ক্যামেরা পার্সন মামুন রেজা। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে আর টিভির দুপুরের সংবাদে লাইভ দিলাম। বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু বৃষ্টি থামে না। মেডিকেল কলেজ চত্ত¡রে পানি জমে গেছে। এমনই সময় এক কিশোরী শ্বাসকষ্ট নিয়ে ইজিবাইক থেকে নামলো। সাথে ছিলো তার মা ও বাবা। কিশোরীর দুই হাত ধরে তার মা-বাবা এগিয়ে যাচ্ছিল জরুরি বিভাগের দিকে। মামুন ভিডিও চিত্র ধারণ করতে থাকলো। আমিও এগিয়ে গেলাম জরুরি বিভাগের সামনে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই কিশোরীর কাছে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসলো।
আমার সম্পাদনায় অনলাইন নিউজ পোর্টাল সংকল্প ডটকম পরিচালিত হয়। মামুন সংকল্প ডটকমে লাইভ সম্প্রচার শুরু করলো। আমাকে লাইভে সংযুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিলে, আমি মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সম্প্রচার শুরু করলাম। উদ্দেশ্য ছিল মানুষ যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে করোনাই সংক্রমিত হলে ওই কিশোরীর মত শ্বাসকষ্ট হতে পারে। কিন্তু বিধিবাম। জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত দুই চিকিৎসক ও এক ইন্টার্নি চিকিৎসক আমার পেশাগত দায়িত্ব পালনে কিছুটা ব্যাঘাত সৃষ্টি করলেন। লাইভ সম্প্রচারে তাদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়লাম। হাজার হাজার দর্শক দেখল। কিছুটা ভগ্ন মনে হাসপাতাল ত্যাগ করলাম। প্রেসক্লাবের সভাপতি আমার সহকর্মী মমতাজ আহমেদ বাপি, সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ সহ কয়েকজন সহকর্মী কে বিষয়টি জানালাম। ওই দিন প্রেসক্লাবে বসে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। সিনিয়র সাংবাদিক কল্যাণ ব্যানার্জি, প্রেসক্লাবের সভাপতি ও প্রেস ক্লাবের সদস্য হাফিজুর রহমান মাসুমকে ঘটনাটি জানালাম। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক ডাক্তার কুদরত-ই-খুদা কে ফোন করে নালিশ জানালাম। তিনি অবশ্য এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন ও পরদিন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। প্রেসক্লাবের হলরুমে মধ্যাহ্নভোজন শেষে সিনিয়র সাংবাদিক কল্যাণ ব্যানার্জি বললেন, এ ঘটনায় প্রেসক্লাবের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া উচিত।
যাই হোক যাদেরকে ঘটনাটি জানিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি সাতনদী পত্রিকার সম্পাদক আমার বন্ধু হাবিবুর রহমান, প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম কামরুজ্জামান, মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল, বাংলাভিশন টিভির প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান সহ অনেকেই তাদের ফেসবুক আইডিতে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে পোস্ট দিয়েছে। সাতক্ষীরা টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের (একাংশ) পক্ষ থেকে তিন চিকিৎসকের অশোভন আচরণের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। ওইদিন রাতে দেখলাম প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজ আহমেদ বাপি তার ফেসবুক আইডি থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অর্থাৎ বিষয়টি আর চাপা থাকলো না।
শনিবার সকাল ১১ টায় টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের আহবায়ক আবুল কাশেম জরুরী সভা আহ্বান করলেন। ওইদিন দুপুর বারোটার দিকে টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভা শুরু হলো। প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজ আহমেদ বাপ্পি এক দু’জনের নাম উল্লেখ করে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে মেডিকেল কলেজে যেতে বললেন। কিন্তু আমি কাউকে রাজি করাতে পারলাম না। উভয় সংকটে পড়ে গেলাম। যাদেরকে মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেছে, তাদের যুক্তি মেডিকেল কলেজে যাব কেন? বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রেসক্লাব অথবা অন্য কোথাও বসতে পারি। সভা চলমান অবস্থায় মেডিকেল কলেজের প্রফেসর ডক্টর কাজী আরিফ আহমেদ ফোন করলেন। তার সাথে মিটিং এর পরে কথা বলব বলেছিলাম। টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের মিটিং শেষ হলো। সভাশেষে ডক্টর কাজী আরিফ আহমেদ সাহেবের সাথে কথা বললাম। তিনি বিষয়টি নিষ্পত্তির প্রস্তাব দিলেন। কারো কাছে না শুনেই তার প্রস্তাবে রাজি হলাম। কারণ এই মহামারীর মধ্যে আমাদের চিকিৎসক সমাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছে। আমার সাথে অশোভন আচরণের ইস্যু নিয়ে সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুরা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে এই মহামারীর মধ্যে সাতক্ষীরার মানুষ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হবে। অসুস্থ মানুষের প্রতি চিকিৎসকদের সেবা কার্য ব্যাহত হবে। ডাক্তার কাজী আরিফকে টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলার পরামর্শ দিলাম। একই সাথে টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন যে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা স্থগিত করার জন্য জোর অনুরোধ করলাম। ডাক্তার কাজী আরিফের প্রস্তাবে টিভি জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন বিষয়টি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিল। ওই দিন রাত ৯ টায় সার্কিট হাউসে বসে সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে ঘটনাটির নিষ্পত্তি হল।
পরিশেষে বলতে চাই, সৃষ্ট ঘটনাকে ঘিরে সাংবাদিকদের বিভাজন আবারো লক্ষ্য করলাম। আমি ও আমরা সংকীর্ণ গ্রæপিং থেকে আজও মুক্ত হতে পারিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম, সাতক্ষীরার সব পক্ষের সাংবাদিকদের নিয়ে বিষয়টির সমাধান হোক। কিন্তু তা হলো না। আমরা লক্ষ্য করছি, প্রেসক্লাবের নির্বাচনের শেষে বিজয়ী গ্রæপের সাথে পরাজিত গ্রæপের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বিজয়ী গ্রæপ প্রেসক্লাব পরিচালনা করে। আর পরাজিত গ্রæপ প্রেসক্লাবের কার্যক্রম থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখেন। দীর্ঘদিনধরে আমরা এমনটাই লক্ষ্য করছি। প্রেসক্লাবের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে একগ্রæপ উপস্থিত থাকে, আরেক গ্রæপ থাকে অনুপস্থিত। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে এটা পছন্দ করি না।
আসুন আমরা অতীতের ভেদাভেদ ভুলে পেশাদারিত্বের স্বার্থে সাংবাদিকরা এক প্লাটফর্মে অবস্থান করি। সাধারণ মানুষ সাংবাদিক সমাজের কাছে অনেক কিছু প্রত্যাশা করে। কিন্তু আমরা আমরা কি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি? সমাজের কাছে ও আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ আমাদের দিকে চেয়ে থাকে। কিন্তু আমরা সেই মানুষগুলোর চাওয়া-পাওয়া কতটুকু পূরণ করতে পারি?
লেখক: সম্পাদক, সংকল্প নিউজ ও নিজস্ব প্রতিনিধি, আরটিভি।