এম. বেলাল হোসাইন : মাছ চুরি ও টাকা আত্মসাতের ঘটনায় এক ঘের কর্মচারিকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। পরে লাশের গলায় নাইনলের নেট বেঁধে শ্যালো মেশিন ঘরের আড়ায় ঝুলিয়ে আত্মহত্যার প্রচার দিয়ে গভীর রাতে পুলিশ ম্যানেজ করে ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ সৎকারের চেষ্টা চালানো হয়েছে। শুক্রবার রাত ১০ টার দিকে সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার চম্পাফুল ইউনিয়নের গোবরাখালির একটি চিংড়ি ঘেরে এ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মৃতের নাম বিশ্বজিৎ সরকার (২৬)। তিনি সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার বরেয়া গ্রামের সুধান্য সরকারের ছেলে।
মৃতের মামাত ভাই একই গ্রামের সঞ্জয় সরকার ও কাকাত ভাই ভোলা সরকার জানান, কালিগঞ্জ উপজেলার বন্দকাটি গ্রামের মুজিবর রহমান টুটুল ও টোনা গ্রামের শিবদাস সরকারের পরিচালনাধীন গোবরাখালির ৩৩০ বিঘা চিংড়ি ঘেরের কর্মচারি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছিল একই উপজেলার বরেয়া গ্রামের বিশ্বজিৎ সরকার। তার ভাই তুষার সরকার একই মালিকদ্বয়ের পরিচালনাধীন চম্পাফুল ইউনিয়নের কাঠুনিয়া ডোগরাখালির ২০০ বিঘা চিংড়ি ঘেরে কর্মচারি হিসেবে কাজ করে। দেড় মাস আগে গোবরাখালি ঘের থেকে আড়াই কেজি বাগদা চিংড়ি চুরির অপরাধে মালিক মুজিবর রহমান টুটুল, শিবপদ সরকার, তার মামাত ভাই একই গ্রামের দেবাশীষ সরকারসহ কয়েকজন বিশ্বজিতকে মারপিট করে। আবারো মারপিটের ভয়ে বিশ্বজিৎ পালিয়ে যায় বাড়িতে। পরদিন শিবপদ সরকার, দেবাশীষ ম-ল, সাবেক ইউপি সদস্য লক্ষীপদ সরকার, ঘোজা গ্রামের পলাশ বৈদ্য বরেয়া গ্রামের বাড়িতে বিশ্বজিতকে ধরে আনতে যায়। আগে ভাগে খবর পেয়ে দেবাশীষ পালিয়ে যায়। একপর্যায়ে চাকরি বজায় রাখতে বিশ্বজিতকে খুঁজে এনে দেওয়ার জন্য ভাই তুষারের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। এক সপ্তাহ আগে তুষার বিশ্বজিতকে নিয়ে মালিকদের হাতে তুলে দেন।
স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, বিশ্বজিতকে নাগালে পেয়ে তার উপর ঘেরের আড়াই কেজি মাছ চুরি ও মাছ বিক্রির ৪০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নির্যাতন চালায় শিবপদ সরকার, দেবাশীষ সরকার, টুটুল মোড়লসহ তাদের লোকজন। এভাবে এক সপ্তাহ ধরে তাকে ঘেরের বাসায় আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হতো। একপর্যায়ে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে শিবপদ সরকার, দেবাশীষ ম-ল, টুটুল মোড়লসহ তাদের ঘের কর্মচারিরা বিশ্বজিতকে কয়েক দফায় মারপিটের একপর্যায়ে রাত ১০টার দিকে ঘেরের বাসায় বিশ্বজিৎ মারা যায়। বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মৃতের গলায় নাইনলের নেট দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে ঘেরের শ্যালো মেশিনের বাসার আড়ায় ঝুলিয়ে দিয়ে আত্মহত্যার প্রচার দেওয়া হয়। একইসাথে মৃতের ভাই তুষার সরকারকে দিয়ে ভাই বিশ্বজিৎ মানসিক রোগী হওয়ায় আত্মহত্যা করেছে মর্মে একটি কম্পিউটার কম্পোজকৃত কাগজে সাক্ষর করিয়ে নেওয়া হয়। রাতেই থানাকে ম্যানেজ করে উপপরিদর্শক হেকমত আলীকে শুক্রবার দিবাগত রাত একটার দিকে গোবরাখালি ডেকে এনে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের জন্য একটি কাগজে মৃতের মা কৌশল্যা সরকার, ভাই সূর্যপদ সরকার ও তুষার সরকারের সাক্ষর করিয়ে নেয় পুলিশ ও নির্যাতনকারিরা। এরপরপরই তুষারকে দিয়ে রাতেই লাশ সৎকার করার জন্য বলা হয়। বিষয়টি সাংবাদিকদের জানানোয় তারা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলায় শনিবার ভোরে লাশ ময়না তদন্তের জন্য কালিগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
স্বজনরা আরো অভিযোগ করে বলেন, হত্যার ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মোটা অংকের টাকা দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে আত্মহত্যার ঘটনা দেখিয়ে ইচ্ছামত সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়না তদন্ত ছাড়াই রাতের আঁধারে লাশ সৎকারের চেষ্টা করা হয়। পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসতে পারেন এমন খবর পেয়ে ওই ঘেরে কর্মরত সাতজন কর্মচারিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তবে বিশ্বজিতের নবনির্মিত বাড়ি ও সম্পদ আত্মসাৎ করতে ভাই তুষার এ হত্যাকা-ে জড়িত থাকতে পারে বলে তারা মনে করেন। জানতে চাইলে মৃতের ভাই তুষার সরকার বলেন, তার ভাই বিশ্বজিৎ জমি কিনে নতুন বাড়ি তৈরি করেছে। তবে সে মানসিক রোগী তাই আত্মহত্যা করেছে। মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ৪৩ মিনিটে উপপরিদর্শক হেকমত আলী গোবরাখালি ঘেরে এসে ঝুলন্ত লাশ নামান বলে দাবি করেন তিনি। মৃতের মা কৌশল্যা সরকার ও বড় ভাই সূর্যপদ সরকার জানান, বিশ্বজিৎ কখনো মানসিক রোগী ছিল না। তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে তাদের কিছু জানা নেই। তবে শুক্রবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে উপপরিদর্শক হেকমত আলী ও ঘের মালিকরা ময়না তদন্ত ছাড়াই রাতে লাশ দাফন করতে বলে একটি কাগজে সাক্ষর করিয়ে নেন। এ ব্যাপারে ঘের মালিক শিবপদ সরকারের সঙ্গে শনিবার সকাল ৮টার দিকে তার ০১৭১১-২১৭১৮৭ নম্বর মোবাইল ফোনে কথা বলার চেষ্টা করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তার মামাত ভাই দোবশীষ ম-ল সাংবাদিকদের কাছে বিশ্বজিতকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সে আত্মহত্যা করেছে। একই ঘেরের অংশীদার মুজিবর রহমান টুটুল বলেন, যে ঘেরে বিশ্বজিৎ মারা গেছে সেটি শিবপদ সরকারের ব্যক্তিগত প্রজেক্ট। তাই এ মৃত্যু নিয়ে তার কোন ধারণা নেই।
শুক্রবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে কালিগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক হেকমত আলী জানান, বিশ্বজিৎ আত্মহত্যা করেছে। তাদের পরিবারের কোন আপত্তি না থাকায় লাশ ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
কালিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লস্কর জায়াদুল হক বলেন, প্রথমে ময়না তদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেওয়া হলেও পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তণ করে লাশ ময়না তদন্তের জন্য শনিবার সকাল ৯টায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। মৃতের ভাই তুষার সরকারের আবেদনের ভিত্তিতে এ ঘটনায় শনিবার থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা(২১নং) হয়েছে। ময়না তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ি পরবর্তীতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পূর্ববর্তী পোস্ট