মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত নির্যাতন, হত্যাযজ্ঞ এবং বাস্তুচ্যুত করার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনের পাশাপাশি মানবিক সহায়তার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে তাকিয়ে আছে মুসলিম বিশ্ব। সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি আপাত মানবিক সহায়তা নিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে চায় তারা।
এরই মধ্যে তার দেশের রাষ্ট্রপতির দূত হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পরপরই তার দেশের প্রেসিডেন্টের দূত হিসেবে বুধবার ঢাকা সফরে আসছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসগলু। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এরইমধ্যে একদফা রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠকের পর মঙ্গলবার রাতে সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার দেশের প্রেসিডেন্ট জোকো বিদোদো তাকে তিনটি বার্তাসহ বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন।
ওই বার্তাগুলো হচ্ছে: ১. শরণার্থী সমস্যার কারণে বাংলাদেশের উপর যে বোঝা চেপেছে তার জন্য ইন্দোনেশিয়ার পক্ষে সহমর্মীতা জানানো, ২. বাংলাদেশের উপর চাপ কমানোর জন্য সহায়তা করতে ইন্দোনেশিয়া যে তৈরি আছে সেটা জানানো, এবং ৩. বাস্তব পরিস্থিতি নিয়ে সরাসরি আলোচনা করা।
ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি বলেন, ইন্দোনেশিয়ার সহায়তা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীতিগতভবে সম্মত হয়েছেন। রেতনো মারসুদি জানান, ইন্দোনেশিয় কীভাবে সহায়তা করতে পারে সে বিষয়ে আমরা আলোচনা অব্যাহত রাখবো ।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জানানো হয়, সন্ধ্যায় ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদির সঙ্গে বৈঠকে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা বন্ধে মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মিয়ানমারের সংকট মোকাবেলায় সবরকম সহযোগিতা করবো, কিন্তু তাদের উচিত সহিংসতা বন্ধ করা।
সমাধান প্রসঙ্গে দেশটির উদ্দেশে তিনি বলেন, এটা সামরিকভাবে সমাধান করা যাবে না। রাজনৈতিকভাবে সমস্যার সমাধান করতে হবে। ‘বর্ডার গার্ড-বিজিবি এবং নাসাকার (মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী) মধ্যে সহযোগিতা বাড়ুক, এটাই আমরা চাই।
তিনি জোর গলায় বলেন, প্রতিবেশী কোন দেশে অস্থিতিশীলতা বা বিদ্রোহের জন্য বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে দেবো না। বিদ্রোহ দমনে আমাদের বিজিবিও সহযোগিতা করতে পারে।
মিয়ানমারের নাগরিকদের বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হিসেবে থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের সমস্যাগুলো তাদের বুঝতে হবে। এতো মানুষ আসা আমাদের জন্য বড় বোঝা।
ইন্দোনেশিয়ার পাশাপাশি তুরস্ককেও একইরকম অবস্থানের কথা জানাবে বাংলদেশ। চলমান রোহিঙ্গা সংকট সমাধান, রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবির পরিদর্শন এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সাথে আলোচনা করতে বুধবার বাংলাদেশে আসছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসগলু। সফরে মেভলুত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে দেখা করবেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশকে সহায়তা করতে একটি সমঝোতা সইয়ের বিষয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনালাপ হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্রে আরো জানা যায়, তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যক্তিগত জেটে বাংলাদেশে আসছেন। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে বাংলাদেশর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর কক্সবাজারে যাওয়ার কথা রয়েছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে গত শুক্রবার বিবৃতি দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তিনি একে গণহত্যা বলে উল্লেখ করেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ফোন করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তার অঙ্গীকার করেন।
তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিরাজমান পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো নিপীড়ন ও অভিযানের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সংকট সমাধানে ২০ জন বিশ্ব নেতার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট।
মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য জরুরি ত্রাণ সহায়তার বিষয়ে মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি কথা বলছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
মঙ্গলবার সংস্থার এক বিবৃতিতে মিয়ানমারে অব্যাহত সহিংসতা এবং এর ফলে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
ইউএনএইচসিআরের সদর দপ্তর জেনেভা থেকে সংস্থার মুখপাত্র দুনিয়া আসলাম খান বিবৃতিতে বলেন, গত মাসে মিয়ানমারে উত্তরের রাখাইন রাজ্যে সংঘাত শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আনুমানিক ১ লাখ ২৩ হাজার শরণার্থী প্রবেশ করেছে। মিয়ানমারে বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।
‘নতুন সৃষ্টি হওয়া এ সংঘাতের মূল কারণ খুঁজে বের করা জরুরি, যাতে করে মানুষ আর পালিয়ে আসতে বাধ্য না হয়। সেই সঙ্গে এই ব্যবস্থাও করা উচিত যাতে তারা নিরাপদে এবং সম্মানের সঙ্গে তাদের বাসস্থানে ফিরতে পারে,’ উল্লেখ করে ইউএনএইচসিআরের বিবৃতিতে বলা হয়: যেসব মানুষ বাংলাদেশে এসেছে তাদের অবস্থা করুণ। অনেকেই তাদের গ্রামের বাড়ি থেকে জঙ্গল, পাহাড়, নদী অতিক্রম করে এসেছে। তারা ক্ষুধার্ত, দুর্বল ও অসুস্থ।