বেছে বেছে মুক্তমনা লেখক, স্বাধীনচেতা, নাস্তিক ও যুক্তিবাদী ব্যক্তিদের হত্যা করা-এটাই ছিল কলকাতায় আটক বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)-এর সদস্য সামসেদ মিঞা (২৬) ওরফে তুষার বিশ্বাস ওরফে তানভির এবং রিয়াজুল ইসলাম (২৫) ওরফে সুমনের। আটক দুই বাংলাদেশিকে জেরা করে এই তথ্য পেয়েছে কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)’এর গোয়েন্দারা।
জেরায় তারা স্বীকার করেছে যে ভারতে আনসারুল্লাহ সংগঠন তৈরির ছক ছিল তাদের। এমনকি কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের এক মুক্তমনা ব্লগারকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল তারা।
এসটিএফ সূত্রে খবর, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিস্ফোরক বিভাগের প্রধান ছিল সামসেদ মিঞা। কয়েকবছর আগে বাংলাদেশে একের পর এক ব্লগার হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে নিষিদ্ধ এই জঙ্গি সংগঠনটির বিরুদ্ধে, এই সংগঠনের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে ত্রাস সৃষ্টিকারী জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গেও। গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে যে ভারতে প্রবেশের পর থেকে গত দেড় বছর ধরে তারা হায়দরাবাদ, পাটনা, রাঁচি ও পুনেতে ঘুরে বেড়িয়েছিল। এই সময়কালে তারা কখনও রাজমিস্ত্রী কখনও বা দৈনিক শ্রমিকের কাজে যুক্ত ছিল। কার্যত এভাবেই তারা ধূম্রজাল তৈরি করেছিল এবং এর আঁড়ালে তাদের সংগঠনের জাল বিস্তারের কাজ চালিয়ে যেতে বলে জানতে পেরেছে গোয়েন্দারা। ভারতে থাকাকালীন সময়ে যে জায়গাগুলিতে তারা ছিল তদন্তের স্বার্থে সেই জায়গাগুলিও পরিদর্শনে যেতে পারে তদন্তকারী গোয়েন্দারা।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা মারফত খবর পেয়েই গত মঙ্গলবার কলকাতা স্টেশন থেকে এই দুই বাংলাদেশিসহ মনতোষ দে (৪৬) নামে অভিযুক্ত এক ভারতীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীকেও আটক করে এসটিএফ’এর গোয়েন্দরা।
তাদের কাছ থেকে ল্যাপটপ, পেনড্রাইভ, অস্ত্র, জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার নানা পুস্তিকা, বিস্ফোরক তৈরির বই উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু অস্ত্রও। এরপর রাত থেকেই দফায় দফায় চলে জেরা।
তবে গোয়েন্দাদের মাথা ব্যাথার কারণ জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া হাতে লেখা একটি কাগজে কলকাতার ‘এসপ্লানেড বাস স্ট্যান্ড’ ও ‘ইডেন গার্ডেন’-এই দুইটি জায়গার নাম। কারণ সম্প্রতি ইডেন গার্ডেন’এই ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে টেষ্ট খেলা অনুষ্ঠিত হয়। ওই ম্যাচ দেখতে প্রচুর মানুষও ইডেনমুখি হয়েছিল। আর সেসময় জঙ্গিরা প্রত্যেকেই এই কলকাতাতেই ছিল বলে ধারনা গোয়েন্দাদের। সেক্ষেত্রে ইডেনের ভিড়ে কোন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের কোন নাশকতার ছক ছিল কি না-সেটা জানার চেষ্টা করছে তদন্তকারী কর্মকর্তারা। আবার ইডেনের পাশেই রয়েছে ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড। সেখানেও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন দূর-দূরান্তে যাতায়াত করতে। আর জঙ্গিদেরও টার্গেট থাকে এই ধরনের ভিড়ে ঠাসা জনবহুল জায়গা। সবমিলিয়ে ঘুম কেড়েছে গোয়েন্দাদের।
এদিকে আনসারুল্লা বাংলা টিম (এবিটি)-এর দুই সদস্য ও স্থানীয় অস্ত্র ব্যবসায়ীকে ১৪ দিনের রিমান্ড দিয়েছে কলকাতার আদালত। বুধবার কলকাতার ব্যাঙ্কশাল আদালতে তোলা হলে অভিযুক্তদের আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিমান্ডের নির্দেশ দেয় আদালতের চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সত্য অর্ণব ঘোষাল।
এদিন আদালতে অভিযুক্তদের রিমান্ডের জন্য আবেদন জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিযুষ কান্তি মন্ডল। আদালতে তিনি জানান দুই বাংলাদেশির কাছ থেকে আল কায়দা সম্পর্কিত নানা নথি ও পুস্তিকা উদ্ধার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ভুয়া ভারতীয় আধার কার্ডও পাওয়া যায়। এরা অস্ত্র কেনাবেচার জন্য কলকাতা স্টেশনে মিলিত হয়েছিল। আটক তিনজনের বিরুদ্ধেই অস্ত্র আইন, প্রতারণা, অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ মামলা দায়ের করা হয়েছে। এদেরকে জেরা করে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেতে পারে।
যদিও অভিযুক্তদের আইনজীবী কে.কে.তিওয়ারি এদিন আদালতের কাছে তিনজনেরই জামিনের আবেদন করে বলেন, বাংলাদেশিদের কাছ থেকে যে নথি পাওয়া গেছে তার থেকে এটা প্রমাণিত হয় না যে তারা আল কায়দার সঙ্গে যুক্ত এবং মনতোষ দে’এর কাছ থেকেও কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি বলেও দাবি করেন তিওয়ারি।
দুই পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শুনে অভিযুক্তদের জামিনের আবেদন খারিজ করে দিয়ে পুলিশি রিমান্ডের নির্দেশ দেয় আদালত।
এ ব্যাপারে বুধবার এসটিএফ’এর ডেপুটি কমিশনার মুরলীধর শর্মা জানান, ‘অভিযুক্ত তিনজনকেই নগর দায়রা আদালতে তোলা হয় এবং আগামী ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশি রিমান্ডের নির্দেশ দেয়’।