পবিত্র জেরুজালেম নগরীকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মার্কিন স্বীকৃতির ঘটনায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে তোপের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি দেশটির মিত্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সও ট্রাম্প প্রশাসনের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। কার্যত পুরো বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
নিরাপত্তা পরিষদের অর্ধেকের বেশি সদস্য দেশের আহ্বানে এই জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৮ ডিসেম্বর শুক্রবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বিষয়টির মীমাংসায় ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনার ওপর দেয় যুক্তরাজ্য। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতা থাকায় এ নিয়ে ভোটাভুটির জন্য কোনও প্রস্তাব তোলা হয়নি।
জাতিসংঘে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের স্থায়ী প্রতিনিধি ম্যাথিউ রায়ক্রফ্ট বলেন, ব্রিটিশ দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের কোনও পরিকল্পনা লন্ডনের নেই। যুক্তরাজ্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে।
ফ্রান্সের প্রতিনিধি ফ্রাঁসোয়া ডেলাত্রে বলেন, ট্রাম্পের ঘোষণায় প্যারিস উদ্বিগ্ন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের এমন অবস্থান পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্যেই আরও ভয়ানক পরিণতি নিয়ে আসছে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত রুশ প্রতিনিধি ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ট্রাম্পের ঘোষণায় মস্কো মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন। রাশিয়া মনে করে এই ঘোষণার ফলে মধ্যপ্রাচ্য সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে।
ফিলিস্তিনি দূত রিয়াদ মনসুর ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনে মদদ দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প যে ঘোষণাই দিক না কেন; জেরুজালেম নগরী ফিলিস্তিনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। তবে এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ওয়াশিংটন শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীর অবস্থান হারিয়েছে।’
সুইডেনের দূত ওলোফ স্কুগ বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতিক সনদ লঙ্ঘন করেছেন।
জাতিসংঘে নিযুক্ত চীন, ইতালি, উরুগুয়ে, সেনেগাল, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া, কাজাকিস্তান, ইউক্রেন, জাপান ও ডর্ডানের প্রতিনিধিরাও ট্রাম্পের ঘোষণায় উদ্বেগ জানান।
মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়া বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ সমন্বয়কারী নিকোলাই ম্লাদেনোভ বলেন, ট্রাম্পের এই ঘোষণার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা ব্যাপক আকারে বেড়ে যেতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের অন্য সদস্যদের অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত নিকি হ্যালি। তিনি বলেন, জাতিসংঘ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি রক্ষার বদলে শান্তি নষ্টের চেষ্টা করছে।
নিকি হ্যালি’র ভাষায়, ‘বহু বছর ধরেই জাতিসংঘ ইসরায়েলের প্রতি অসংযতভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছে। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে এটি বরং ক্ষতি বয়ে এনেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র এর পক্ষে অবস্থান নিতে পারে না।’
নিকি হ্যালি বলেন, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি জাতিসংঘ ভয়ানক শত্রুতামূলক আচরণ করছে। দুঃখজনকভাবে সংস্থাটি ইসরায়েলের প্রতি শত্রুতার আন্তর্জাতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের দূত ড্যানি ড্যানোন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া স্বীকৃতিকে স্বাগত জানান।
এদিকে শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ-সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীর। জেরুজালেমকে ইসরায়েলি রাজধানী হিসেবে মার্কিন স্বীকৃতির প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভে ইসরায়েলি বাহিনী বলপ্রয়োগ করলে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। শুধু গাজা উপত্যকাতেই ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন অন্তত দুইজন। আহত হয়েছেন কমপক্ষে ২৫০ জন।
জুমা’র নামাজের পর জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদের বাইরে এবং গাজা উপত্যকায় বিক্ষোভে অংশ নেন হাজার হাজার মুসল্লি। পশ্চিম তীরের হেবরন, বেথেলহেম, রামাল্লাসহ পুরো ফিলিস্তিনজুড়েই এমন বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এসব বিক্ষোভে ইসরায়েলি বাহিনী বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ইসরায়েলি বাহিনীর কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের জবাবে পাল্টা পাথর নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীরা। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ-বিক্ষোভ ঠেকাতে পশ্চিম তীরে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করে ইসরায়েল।
রাস্তায় টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেয় বিপুল সংখ্যক মানুষ। এ সময় তারা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কুশপুতুল দাহ করেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গাজা উপত্যকা থেকে নিক্ষেপ করা একটি রকেট ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে বিস্ফোরিত হয়েছে। জবাবে ইসরায়েলি ট্যাংক ও বিমান থেকে গাজায় হামলা চালানো হয়েছে।