রাজধানীর তেজ-গাঁওয়ের আরজত পাড়ায় নিজ বাড়িতে মিলু মিলরেট গোমেজ (৬৫) নামে এক খ্রিস্টান বৃদ্ধাকে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। গতকাল শুক্রবার সকাল সাতটার দিকে খ্রিস্টান গলির ৩৮, আরজত পাড়ার তিন তলা বাড়ির তৃতীয় তলায় এ ঘটনা ঘটলেও পুলিশ খবর পায় চার ঘন্টা পরে। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। এ ঘটনার পর নিহতের স্বামী ও বাড়ির মালিক হিউবার্ড অনিল গোমেজ (৭৮) কে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। অনিল গোমেজ ঢাকাস্থ আমেরিকান দূতাবাসের স্টোর শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক।
পুলিশ জানিয়েছে ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছে সে বিষয়ে ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী অনিল গোমেজ অসংলগ্ন কথাবার্তা বলছেন বলে। আট কাঠা জমির ওপর নির্মিত বাড়িটি দখলে নিতে কেউ এ ঘটনা ঘটিয়েছে কিনা পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে। অনলি-মিলু দম্পতির চার ছেলের মধ্যে ৩ জন কানাডা ও ১ জন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। ওই ফ্ল্যাটে তারা দুজনই থাকতেন।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য অনুযায়ী সকাল ৭টায় ঘটনা ঘটলেও আমরা খবর পেয়েছি আনুমানিক ১১টার দিকে। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ওই বাড়ির ছুটা বুয়া খুরশী বেগম এসে কাজ করার জন্য ভিতরে ঢুকতে ফ্ল্যাটের কল বেল চাপেন। দীর্ঘ সময় ধরে কল বেল বাজলেও ফ্ল্যাটের দরজা কেউ খোলেনি। অনেক ডাকাডাকির পর শব্দ পেয়ে পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া অ্যাডভোকেট সুভাস চন্দ্র সাহা এসে ওই দরজা ধাক্কাধাক্কি করেন। এক পর্যায়ে অনি গোমেজ দরজা খুলে দেওয়ার পর ড্রইং রুমের মেঝেতে রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। এরপর সকাল ১১ টার দিকে এক ব্যক্তি পুলিশের হ্যালো ৯৯৯ এ ফোন করে হত্যার ঘটনাটি জানায়। পুলিশ গিয়ে দেখতে পায় ড্রইং রুমের মেঝেতে রক্তাক্ত লাশ। নিহতের গলায় কাটা চিহ্ন ছাড়াও বুকে ছুরিকাঘাতের একাধিক চিহ্ন রয়েছে। লাশের পাশ থেকে হত্যায় ব্যবহূত ধারালো ছুরিও উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জের উলুখোলা গ্রামে।
হত্যার খবর পেয়ে মিলু গোমেজের গ্রামের বাড়ি থেকে ভাই ও বোনের পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই সেখানে ছুটে আসেন। মিলুর ছোট বোন রিটা পেরেরা শেলী বলেন, ৭ বোন ও ৫ ভাইয়ের মধ্যে মিলু ছিলেন চতুর্থ। মিলুর চার ছেলের মধ্যে স্ট্যানলি গোমেজ, রবার্ট ক্লাইভ গোমেজ ও লিংকন গোমেজ কানাডা প্রবাসী। তারা সবাই বিয়ে করে সেখানে স্থায়ী নাগরিকত্ব নিয়েছেন। ছোট ছেলে মোজেস গোমেজ বছর দুয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মিলু গাজীপুরের উলুখোলার পাউরান এলাকায় গিয়েছিলেন তাদের একটি নির্মানাধীন বাড়ি দেখতে। গতকাল সকাল পৌণে ৬ টার দিকে মিলু তার মোবাইল ফোনে কল করেছিলেন। ওই সময় তিনি চার্চে ছিলেন। তখন তার নাতি ফোন ধরেছিল। মিলু বলেছিলেন যে দুপুরে তিনি গাজীপুরের বাসায় আসবেন। তার আগেই তিনি খুন হয়ে গেলেন।
মিলুর ছোট ভাই হেনরি গোমেজ বলেন, মিলু ও তার স্বামী ৯ মাস কানাডায় থাকার পর গত অক্টোবরে দেশে ফিরেন। কানাডায় তাদের তিন ছেলে বার বার অনুরোধ করেছে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য। আগামী বছরের মধ্যে তাদের সব সম্পদ বিক্রি করে করে কানাডায় যাওয়ার কথা ছিল।
মিলুর ভাগ্নী অঝর পেরোরা বলেন, ফার্মগেটে ৭৯, গ্রিন রোডের ইউসিসি মার্কেটে তৃতীয় তলা তার খালার নামে ২টা ফ্ল্যাট কেনা আছে। আরজত পাড়ার ৮ কাঠা জমির ওপর তিন তলা বাড়িটি অনিলের নামে। এসব সম্পদ নিয়ে কারো সঙ্গে কোন দ্বন্দ্ব আছে কিনা- তা তারা জানেন না।
নিহতের নিকটাত্মীয় দুলাল ডি কস্তা অভিযোগ করেন, ঘটনার পর থেকে তারা বাসায় মিলু ও অনিলের পাসপোর্ট ও জমির দলিল খুঁজে পাচ্ছেন না।
গতকাল বিকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে যায়, তিন তলার ওই ফ্ল্যাটে নিহতের পরিবারের নিকট আত্মীয়দের ভীড়। ড্রইং রুমের সোফায় বসে ছিলেন অনিল গোমেজ। বয়সের বারে একেবারে ন্যূব্জ হয়ে পড়েছেন। তার ডান চোখের নীচে রক্তের দাগ লেগে আছে। এ ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে বলেন, ‘আমি সোফার এক দিকে বসেছিলাম। একজন এসে আমার মুখমণ্ডল কাপড় দিয়ে পেঁচিয়ে দেয়। পরে ছুরি দিয়ে মেঝেতে তাকে (মিলু) জবাই করা হয়। কল বেল চাপলে আমি দরজা খুলে দিই।’ আবার এ ব্যাপারে আরেক প্রশ্ন করা হলে তিনি অসংলগ্ন উত্তর দেন।
পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া অ্যাডভোকেট সুভাস চন্দ্র সাহা বলেন, তিনি এক বছর আগে এই বাড়িতে ভাড়াটিয়া হিসাবে আসেন। বাড়িতে কোন সিকিউরিটি গার্ডও নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কোন সিসি ক্যামেরাও স্থাপন করা হয়নি।
পুলিশের উপ-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, অনিলের শরীরের রক্তের দাগ রয়েছে। ঘাতকরা যদি তার সামনে স্ত্রীকে হত্যা করে, তাহলে কেনইবা অনিলকে ছেড়ে দিল। আবার হত্যার ঘটনা ঘটার পরও অনিল কেনইবা বিষয়টি গোপন করার চেষ্টা করেছিল-তা নিয়েও রহস্য রয়েছে। এছাড়া বাহির থেকে কেউ ঢুকে হত্যা করেছে কিনা তা নিয়েও স্পষ্ট কোন তথ্য অনিল দিতে পারেননি। বয়স বিবেচনায় অনিলকে পুলিশের নিরাপদ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী অনিলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।