আজ চৈত্র সংক্রান্তি। ঋতুরাজ বসন্তের বিদায়ের মধ্য দিয়েই বর্ষবিদায়ের আয়োজন শুরু হচ্ছে। চৈত্র সংক্রান্তি মানেই বাংলা বছরের বিদায়ের সুর। আর কোনও দেশে বোধহয় এত আয়োজন করে বছর বিদায় দেওয়া হয় না। গ্রাম-বাংলায় বর্ষ শুরুর মতোই গুরুত্ব দিয়ে আয়োজন করা হয় চৈত্র সংক্রান্তির। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ উৎসবের আয়োজনের জৌলুস কমেছে। বিবর্ণ হচ্ছে ঋতুরাজ বসন্ত বিদায়ের রঙ।
লোক সংস্কৃতির গবেষকদের মতে, চৈত্র সংক্রান্তি প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের শাস্ত্রীয় উৎসব, যা ক্রমেই লোক সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। শাস্ত্র ও লোকাচার অনুসারে এই দিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পুণ্যজনক মনে করা হয়।
সংক্রান্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব চড়কপূজা ও গাজন। গাজন মূলত কৃষকদের উৎসব। চৈত্রের দাবদাহ থেকে রক্ষা পেতে বৃষ্টির জন্য চাষিরা পালার আয়োজন করে থাকেন। এটিই গাজন।
বলাই বাহুল্য, বাঙালির যে কোনও উৎসবের সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার আচার ওতপ্রতোভাবে জড়িত। এই দিনেও তার ব্যতিক্রম হয় না। এই দিনের খাবার প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ১৪ রকমের শাক ও তিতা-মিঠা দিয়ে সংক্রান্তি আয়োজন করা হয়। এই ১৪ রকম শাক হতে হবে বাড়ির আশপাশে বেড়ে ওঠা নানাপদের শাক। গ্রামাঞ্চলের গৃহস্থরা বিশ্বাস করেন, এই ১৪ রকমের শাক-পাতা পাওয়ার বিষয়টি প্রাকৃতিকভাবে শুভ। এরমধ্য থেকে কোনও শাক না পাওয়া গেলে প্রকৃতির কোনও অসঙ্গতিতেই পাওয়া যায়নি বলে ধরে নেওয়া হয়। বলা হয়, এতে বেশি রোদ পড়তে পারে, অতিবৃষ্টি হতে পারে, যা কৃষির জন্য ক্ষতিকর। শাকপাতাই জানান দেবে আসন্ন প্রকৃতির রঙ।
চৈত্র সংক্রান্তির ইতিহাস নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন কবির বলেন, ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসে কৃষি দেবতা হিসেবে বিবেচিত হন শিব। শিবের পূজা, শিবের অর্চনাই চৈত্র সংক্রান্তির মূল আয়োজন। ধীরে ধীরে শিব পূজা, চড়ক গাজন কমে আসছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু সামাজিকভাবে কেন, পাঠ্যক্রমে চৈত্র সংক্রান্তি ও শিবের বিষয়টি উপেক্ষিত। যেখানে নাট্যকলার ইতিহাস হিসেবে আমরা গ্রিক নাট্য শিল্পের ইতিহাস, গ্রিসের কৃষি দেবতার ইতিহাস পড়ে আসছি, অথচ তার চেয়েও বহু পুরনো কৃষি দেবতা শিব। ভারতবর্ষে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসবই গড়ে উঠেছে এই শিবের গাজন হিসেবে। সংক্রান্তিতে যে গাজন, পালা, গীত হয়ে থাকে এটিই বাংলা নাট্যসাহিত্যের মূল ভাণ্ডার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহুরে কর্পোরেট সংস্কৃতির চাপে সংক্রান্তির আয়োজন রঙ হারাচ্ছে।’
তবে এখনও বিশাল আয়োজন করে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা পালন করেন বিজু। বৈশাখের ঝড়ের পরেই জুম চাষ শুরুর প্রত্যাশা নিয়ে চৈত্রকে বিদায় দেন তারা। পানিতে ফুল ভাসিয়ে বিদায় দেন বসন্তকে, একইসঙ্গে বিদায় দেন পুরনো বছরকে। তেমনি সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও পালন করেন হুতুম পূজা, সংক্রান্তি পূজা।
সংক্রান্তির পালা, গাজন, চড়ক বা মেলাতে ঘাটতি পড়লেও তিতা-মিঠা খাওয়ার চল রয়েই গেছে। তিতকুটে নানা পদের শাকের ঝুড়ি ভাজা, সঙ্গে কাঁচা সরিষার ভর্তা, ধোয়া ওঠা লালচে আউশ চালের ভাত আর শুকনো মরিচ ভাজা। চৈত্রের শেষদিন নাকি তিতকুটে আর ভর্তা খেতে হয়। এতে সমস্ত রোগ বালাই বৈশাখের প্রথম ঝড়ের সঙ্গে চলে যাবে–এমনটিই বিশ্বাস করা হয়। সঙ্গে থাকে কড়া আমের ডাল, কিংবা বড়ই দেওয়া ডাল।
বাংলা একাডেমির সহপরিচালক ও লোক গবেষক ড. সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘শহরে চৈত্র সংক্রান্তির জৌলুস না থাকলেও গ্রাম-বাংলায় এর ঘাটতি পড়েনি। যুগে যুগে বাংলার হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে সংক্রান্তি উৎসব পালন করে এসেছে। এখনও তাই হয়। গ্রামে গ্রামে সংক্রান্তির আয়োজন গত একমাস ধরেই শুরু হয়ে গেছে। গত একমাস ধরে ঢাকার খুব কাছের জেলা বিক্রমপুরে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা হচ্ছে। একই জিনিস দেখা গেছে নরসিংদীতে। হচ্ছে মুখোশে ঢাকা হরগৌড়ি নাচ, বাইদান নাচের পালা। সব ধর্মের মানুষ নির্বিশেষে অংশ নিচ্ছে। হালখাতার শুরুটিও হচ্ছে এই সংক্রান্তিকেই ঘিরে। সংক্রান্তিতে হালখাতা শুরু হয়ে বৈশাখ বরণেও চলে।’
তবে আগে যেমন সংক্রান্তি ঘিরে দীর্ঘদিন মেলা হতো, ষাড়ের লড়াই, লাঠি খেলা হতো– সেসবে একটু ভাটা পড়েছে স্থানের অভাবে। এখন আর আগের মতো খোলা মাঠ পাওয়া যায় না, বা ধান কাটা শেষে ক্ষেত খালি পড়ে থাকে না। ১২ মাসই ধান চাষ হচ্ছে কিংবা ফসল বা অন্যান্য আয়োজনের ফলে সংক্রান্তি আয়োজনে একটু ঘাটতি পড়েছে।