পশ্চিমারা প্রায়ই প্রাচ্যের মানুষের আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারে না। ইরাকের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের ভয় ছিল ইরানপন্থীদের নিয়ে। এখন সমস্যা প্রচণ্ড জাতীয়তাবাদী মুক্তাদা আল সদর ও তাঁর কমিউনিস্ট সঙ্গীরা। কোনো মিডিয়া তাদের জয়ের আভাস পায়নি, কিন্তু জনগণ বেশি ভোট দিয়েছে তাদেরই। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, মুসলমানদের পবিত্র শহর নাজাফে জয়ী হয়েছেন এক কমিউনিস্ট নারী।
এখন আমেরিকানদের চিন্তা কেন মার্কিনপন্থী আল আবাদি সরকার নির্বাচনে হারল? তারা কি ইরাক থেকে আইএসকে খেদায়নি? স্বাধীনতার পক্ষে গণভোটের পর কুর্দি শহরগুলোকে সেনা পাঠিয়ে আটকে ফেলেনি? আর তারা কি আমেরিকান বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ইরাককে মুক্ত করছে না? পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন চালাচ্ছে না?
এসব বুলির উল্টো দিকে মানুষ দেখেছে ইরাককে নিয়ে আমেরিকা ও ইরানের ভাগাভাগির খেলা, দেখেছে দুর্নীতি ও গোষ্ঠীগত বিভক্তি। এ জন্যই কমিউনিস্ট-সদর জোটের ডাকেই মানুষ সাড়া দিয়েছে। এটা শুধু আমেরিকাকেই নয়, ইরানকেও দেওয়া ইরাকিদের জবাব। নির্বাচনের আগে আগে এক ইরানি রাজনীতিবিদ ইরাকে বসে হুঁশিয়ারি দেন, ইরাকে তাঁরা উদারপন্থী ও সেক্যুলারদের শাসন চালাতে দেবেন না। কিন্তু এখন তাদের গুনতে হচ্ছে উদারপন্থী সদর ও কমিউনিস্টদের সায়েরৌন জোটকে। বাংলায় এই জোটের নাম হবে, ‘এগিয়ে চলো’। সদর ইরানের শিয়াধর্মীয় নেতা। ইরাকের শীর্ষ শিয়া আধ্যাত্মিক নেতা আলী আল–সিস্তানির আশীর্বাদ কিন্তু তাঁর দিকেই। ইরাক আগ্রাসনের পর মাহদি আর্মি গঠন করে স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন; তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩০। সদরের উদারতা এখানেই, তিনি সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের বিপক্ষে, কেননা তা বিদেশি শক্তির জন্য পথ করে দেয়। তিনি কুর্দিদের সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষে। ক্ষমতাসীন মার্কিনপন্থী আল-আবাদি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও বিদেশি আনুগত্যের অভিযোগ তুলে কমিউনিস্টদের সঙ্গে জোট বাঁধেন। সদরপন্থীদের ডাকটা খুবই সরল, কিন্তু আজকের দুনিয়ায় সবচেয়ে সাহসী: আমেরিকা বা ইরান নয়, ইরাক চালাবে ইরাকিরাই। শিয়া হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্নে ইরানকে ছাড় দিতে নারাজ ৪৫ বছর বয়সী মুকতাদা আল সদর। জাতীয় স্বার্থ ছাড়লে আরো আগেই তিনি ইরাকের শাসক হতে পারতেন।
সায়েরৌন জোট একা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। তাকে ক্ষমতাসীন আল-আবাদির জোট কিংবা সাবেক প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকির জোটকে সঙ্গে নিতে হবে। এ ছাড়া বারজানির কুর্দি দলেরও ক্ষমতামুখী জোটে থাকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু যদি আবাদি আর মালিকি জোট বাঁধেন, তাহলে সদর ও কমিউনিস্টদের বৃহৎ বিরোধী দলের ভূমিকাতেই সন্তুষ্ট হতে হবে। তাতে ইরান খুশি হবে। আর আমেরিকা আপাতত যেকোনোভাবে ইরানকে ঠেকাতে পারলেই খুশি, তাই সদরের মতো পশ্চিমা বিরোধী জাতীয়তাবাদীকে মেনে নিতে তারা রাজিই থাকবে।
সদর জাতীয়তাবাদী বটে, কিন্তু নির্বাচনের আগে ইরানের সঙ্গে সমঝোতার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ইরান চাইলে ইরানপন্থী জোটের নেতা হাইদি আল-আমিরির সঙ্গেও সদরপন্থীরা সরকার গঠন করতে পারে। ক্ষমতায় যান বা না যান, সদরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চললে ইরাকে হয়তো আমরা ইরানপন্থী ও সদরপন্থী শিয়াদের মধ্যে বিরোধ দেখতে পাব। সেটা ইরান বা ইরাক কারও জন্যই ভালো হবে না। তা ছাড়া পরমাণু চুক্তি বাতিলের পরে যেভাবে সিরিয়ায় ইরানি অবস্থানের ওপর ইসরায়েল বোমা হামলা চালাচ্ছে, তাতে ইরানের জন্য সদরের সঙ্গে আপস করে নেওয়াই সবচেয়ে ভালো। ইরাক এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইরানি মিত্র। ইরানের উচিত ইরাকের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলিয়ে মৈত্রীর মর্যাদা দেওয়া। এ জন্য ইরাকের ইরানপন্থী শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীর প্রতাপ কমাতে হবে।
তবে কমিউনিস্টদের প্রত্যাবর্তন ছিল ইরাকের জাতীয় নির্বাচনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা। গত শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকেই ইরাক-ইরান-সিরিয়া-মিসরের মতো দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন জোরদার হয়। এসব দেশে রাজতান্ত্রিক ও ঔপনিবেশিক শাসন ঘুচিয়ে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের জন্য জীবন দেয় অসংখ্য কমিউনিস্ট। তাদের প্রভাবেই অসাম্প্রদায়িক বাথ পার্টির আরব জাতীয়তাবাদ আরবের দেশে দেশে ক্ষমতাসীন হয়। আরব জাতীয়তাবাদের ওই মডেলের দুটি উপাদান ছিল স্পষ্ট: কমিউনিস্ট-বামপন্থী এবং ইসলামমনা দল। এমনকি ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা পিএলওর মধ্যেও দেশপ্রেমিক বাম-ডানদের সমাবেশ ঘটান ইয়াসির আরাফাত। আরবের ইতিহাস বলে, যখনই সেক্যুলার ও ইসলামপন্থীরা জোট বেঁধেছে, তখনই আরব দেশগুলো মর্যাদা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পরের দিকে বাথ পার্টি শাসিত দেশগুলোয় আমরা এক ব্যক্তির শাসন কায়েম হতে দেখি। অন্যদিকে, সৌদি-মার্কিন আঁতাত মুসলিম দুনিয়ায় কমিউনিস্টবিরোধী প্রচার চালাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে। এর ফল হয় বাম-মুসলিম দলগুলোর বিরোধ। আজ যে সৌদি মদদে মিসরসহ উপসাগরীয় দেশগুলোয় মুসলিম ব্রাদারহুডের দমন চলছে, সেই মুসলিম ব্রাদারহুডকে দিয়েই সৌদি আরব ষাট-সত্তর দশকে কমিউনিস্টদের ঠেকিয়েছিল। সেভাবে ব্যবহৃত হওয়ার খেসারত ব্রাদারহুড এখন দিচ্ছে সৌদির বন্ধু মিসরীয় জেনারেল সিসির হাতে নির্যাতিত হওয়ার মাধ্যমে।
ইরাকে বাম ও ইসলামি শক্তির এই জোটবদ্ধতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির পালাবদলের ইঙ্গিত দেয়। এ ঘটনা মনে করিয়ে দেয় এক ভুলে যাওয়া মুসলিম কমিউনিস্ট নেতাকে। তাঁর নাম সুলতান গালিয়েভ। গালিয়েভের জন্ম সাবেক রুশ সাম্রাজ্যের কাজাখ এলাকায় এক মধ্যবিত্ত তাতার পরিবারে, ১৯০০ সালে। গালিয়েভ তরুণ বয়সে বলশেভিক পার্টিতে যোগ দিয়ে কাজাখ অঞ্চলে সশস্ত্র বিপ্লবী লড়াইয়ে শামিল হন। ১৯২০ সাল নাগাদ তিনি গঠন করেন রুশ কমিউনিস্ট পার্টির মুসলমান শাখা: মুসলিম কমিউনিস্ট কংগ্রেস। তাঁর চিন্তা ছিল, প্রাচ্যের মুসলমান দেশগুলো তথা তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, উজবেকিস্তানসহ সাবেক রুশ সাম্রাজ্যের মুসলমান অঞ্চলে জাতীয়তাবাদী বিপ্লব করে সমাজ প্রগতি সম্পন্ন করবেন। শ্রেণিসংগ্রামের চেয়ে তাঁর আগ্রহ ছিল ওসব অঞ্চলে রুশ ভূস্বামী ও ব্যবসায়ীদের আধিপত্য কমানো তথা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের দিকে। দূরবর্তী লক্ষ্য ছিল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে সমগ্র মুসলিম প্রাচ্য তথা আফগানিস্তান-ভারত-আরব অঞ্চলে স্বাধীনতার লড়াইকে বেগবান করা। স্তালিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির জাতিগত সমস্যাবিষয়ক কমিটির সদস্যও ছিলেন তিনি। কিন্তু অচিরেই স্তালিন তাঁর ভেতরে অতিরিক্ত জাতীয়তাবাদ আবিষ্কার করেন। বিশ্বের প্রলেতারিয়েতের চেয়ে সুলতান নিজ অঞ্চলের কৃষক জনতার মুক্তির বিষয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন। যেখানে শিল্পায়ন হয়নি, সেখানে প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বকে তাঁর বাস্তববাদী মনে তো হয়ইনি, বরং মনে হয়েছে নতুন করে রুশ আধিপত্য কায়েমের কৌশল। তিনি বাহিনী গঠন করে তাঁর কাজ চালিয়ে যেতে থাকলে পরাক্রমশালী সোভিয়েত শাসক স্তালিন তাঁকে গ্রেপ্তার করেন, আবার ছাড়েন। ছাড়া পেয়ে সুলতান কাজ চালিয়ে যেতে থাকলে তাঁকে শ্রমশিবিরে পাঠানো হয়। ১৯৩০ সালের পর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায় না। পরে সোভিয়েত নেতা কামেনেভ ও বুখারিন গালিয়েভের বিষয়ে অন্যায় করা হয়েছিল বলে স্বীকার করেন।
সুলতান গালিয়েভের জীবন ট্র্যাজিক পরিণতি পেলেও তাঁর এই জাতীয় মুক্তির লাইন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। গালিয়েভ যখন শ্রমশিবিরে, তখন মাও সে তুং চীনে জাতীয় মুক্তির রণনীতি নিয়ে সংগ্রাম চালাচ্ছেন। আরও পরে আমরা দেখি, তাঁর পথানুসারী আফ্রো-এশীয় ব্লকের উত্থান এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। নির্দিষ্ট সমাজবাস্তবতায় নির্দিষ্ট কৌশল নেওয়ার যে কথা বলেছিলেন গালিয়েভ, ইরাকের কমিউনিস্ট পার্টি সেই লাইনই ধরে রেখেছে এবং সফলতা পাচ্ছে। ধর্ম বিষয়ে পশ্চিমা কমিউনিস্টরা যে ভুল করে থাকে, সেই দায় দুনিয়ার সব কমিউনিস্টের ওপর বর্তায় না। ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনাও কিন্তু মুসলিম আলেম ও বুদ্ধিজীবীদের দ্বারাই হয়েছিল। উসমানি ভাইয়েরা, মোহাম্মদ আলী, আলী আকবর থেকে কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ পর্যন্ত সেই ধারা বহমান ছিল। তাঁদের নেতা ছিলেন এম এন রায়। সম্প্রদায় চিন্তা না করেই তাঁরা মানুষের মুক্তির আওয়াজই তুলেছিলেন।
ইরাকে শিয়া নেতা সদর এবং কমিউনিস্ট পার্টির এই জোটবদ্ধতা সেই হারানো ধারাকেই মনে করাচ্ছে। ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক ও মতবাদের বিরোধে কিন্তু ক্ষতি হয় বিশ্বাসীর, সম্প্রদায়ের দরিদ্র ও প্রান্তিক নর-নারীর। মতবাদের চেয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থ ও জীবন বড়, ইরাকে সদরপন্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা সেই শিক্ষাটা ফিরিয়ে আনল।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।