স্বাস্থ্য ডেস্ক: সিয়াম সাধনা আর সংযমের মাস রমজান। সারা দিনের সংযমের পর ইফতারির সময় আমাদের সব সংযম যে হারিয়ে যায়। মনে হয় রমজান এসেছে শুধু বেহিসাবি ও রকমারি খাবারের বার্তা নিয়ে। ভোজনরসিক অনেক বাঙালির ক্ষেত্রে রমজান যেন শুধু খাওয়ারই উৎসব। যুগ যুগ ধরে বাঙালি ধরে রেখেছে এই ইফতারির ঐতিহ্য।
সারা দিন রোজা রেখে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিস্তেজ হয়ে পড়ে। ইফতারের পর সেগুলো ধীরে ধীরে সতেজ ও কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। তাই সবার মনে রাখতে হবে, এই ইফতারে যেন এমন কিছু খাওয়া বা পান করা না হয়, যাতে ওই অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো সতেজ ও কর্মক্ষম হওয়ার পরিবর্তে দুর্বল হয়ে পড়ে। রোজাদারের মধ্যে কেউ সম্পূর্ণ সুস্থ থাকে, আবার কেউ ডায়াবেটিক, কেউ হৃদরোগী কেউ বা আলসার আক্রান্ত থাকতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, কার জন্য কোন ইফতার ক্ষতিকর; সেগুলো খাওয়া ঠিক হবে না।
রোজার একটি পরম আনন্দ ও তৃপ্তি হলো ইফতারে। সারা দিন রোজা রেখে দিন শেষে পরিবারের সবাই যখন একসাথে ইফতারে বসে এবং পরিবারের বাইরে হাটবাজারে, মসজিদে সবাই যখন একসাথে বসে ইফতার করে, তখন সবার মনে এক অনাবিল আনন্দ বিরাজ করে। কোথাও কোথাও ইফতার বিনিময় করে আনন্দে ও তৃপ্তিতে। কিন্তু এই ইফতার করতে গিয়ে কখনো আমরা বাড়াবাড়ি করে অসুস্থ হয়ে পড়ি।
লোভ সংবরণ করাও রোজাদারের জন্য ইবাদত। লোভ সংবরণ করে যদি সুস্থ থাকতে পারি, তাহলে সেটাই কি ভালো নয়? লোভ সামলাতে না পেরে যদি এমন কিছু খাই, যা আমার কষ্ট বৃদ্ধি করে, সেটা কি আমাদের কাম্য হওয়া উচিত? ভাজাপোড়া বা ঝলসানো কোনো খাবারই স্বাস্থ্যের জন্য উপাদেয় নয়। তবুও মুখরোচক বলে খাই। কিন্তু সেটাও সংযত হওয়া ভালো।
আমরা বলি, দিন শেষে পেঁয়াজু, ডালবড়া, আলুর চপ, কাবাব, গ্রিল করা মুরগি না খেলে ভালো লাগে না; কিন্তু সারা দিন উপবাস থেকে এই তেলে ভাজা খাবার যে কত ক্ষতিকর তা বুঝি না বা বুঝতে চাই না বলে অসুস্থ হয়ে পড়ি। পেটে গ্যাস হয়। টক ঢেঁকুর উঠতে থাকে। পেট ফুলে ওঠে। মাথা গরম হয়। পেটে উৎপন্ন গ্যাস ওপর দিকে চাপ দেয়। তখন বুকে ব্যথা হয়।
আল্লাহর রাসূল শুধু সাদা পানি ও খোরমা বা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। আমরা ইফতারে ভেজানো নরম চিঁড়া ও কলা, চিঁড়া ও টকদই বা মিষ্টিদই, শসা, ক্ষীরা, তরমুজ, বাঙ্গি ইত্যাদি দিয়ে ইফতার করতে পারি। এগুলো ভালো। লেবুর শরবতে ইসবগুলের ভুসি দিয়ে খেতে পারি। মুড়িতে অল্প তেলে ভাজা সেদ্ধ ছোলা খাওয়া যায়।
ডায়াবেটিক না থাকলে গুড় বা চিনির ফিরনি বা ক্ষীর খেতে পারেন। এগুলো ক্ষতিকর নয়। হৃদরোগী, ডায়াবেটিক রোগী, পেটে আলসার ও গ্যাস্ট্রিক রোগীদের ভাজাপোড়া খাওয়া নিষেধ। ইফতারের পর নামাজ শেষে শুয়ে পড়া ঠিক নয়। অন্তত ১৫-৩০ মিনিট হাঁটাচলা করা উচিত। যথেষ্ট পরিমাণে পানি পান করতে হবে। বাজারে যেসব টিক্কা, কাবাব ইত্যাদি বাহারি খানা পাওয়া যায়, ওইসব খাবার না খাওয়াই উচিত।
সেহরি বা রাতের খাবারে শাকসবজি, মাছ ও ডাল খাওয়া ভালো। যাদের পেটে আলসার তাদের সর্বপ্রকার ভাজাপোড়া খাবার নিষিদ্ধ। তাদের ইফতারে অবশ্যই এক কাপ টকদই খাওয়া উচিত। অথবা টকদই আর কলা মেখে খেলে উপকার হবে। যারা হৃদরোগী তারাও এটা খেলে ভালো হবে।
যারা পেপটিক আলসারে ভুগছেন, তারা ইফতারে কোনো ভাজাপোড়া বা ঝলসানো কিছু খাবেন না, বরং কচি শসা খেলে উপকার হবে। তবে লেবুর শরবত খাবেন না। রূহ আফজা, সিনারোজ বা মর্ডান শতায়ু শরবত খেতে পারেন। চিঁড়া-দই বা চিঁড়া কলা খাবেন।
যারা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন, তাদের জন্য ভাজাপোড়া নিষেধ। লাল গোশত না খাওয়াই ভালো। তাজা কচি মুরগি পেঁপে বা মানকচু দিয়ে কম গরম মসলা সহযোগে রান্না করে খেতে পারেন। ইসবগুলের ভুসির শরবতও উপকারী।
সেহরি বা রাতের খাবারে শাকসবজি, মাছ, ডাল ও সালাদ খাবেন। সেহরি বা ভোরে গোশত না খাওয়াই ভালো। হালকা খাবার শ্রেয়। যেমন-আটার রুটি, সেমাই, কম তেলে রান্না সবজি। খাওয়া শেষে এক গ্লাস মাঠা বা ঘোল অথবা টকদইয়ের শরবত খাবেন।
আমাদের রোজাদারদের মনে রাখতে হবে, দিন শেষে রাজকীয় খাবার, যেমন-পোলাও, বিরিয়ানি, কোপ্তা, কাবাব খাওয়ার জন্য রোজা রাখি না। ইবাদত-বন্দেগি ও জিকির করার জন্য রোজা, বেঁচে থাকার লক্ষ্যে খাওয়া-দাওয়ার জন্য রোজা নয়। ভুলে গেলে চলবে না, আল্লাহর রাসূল সামান্য ফলমুল বা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন।