দেশের খবর: বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের প্রচারণা শেষ। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বেঁধে দেয়া সময়সীমা অনুযায়ী শনিবার মধ্যরাতে প্রচারণা শেষ হয়েছে। রাত পোহালেই আগামীকাল সোমবার এই তিন সিটিতে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। মেয়র, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনে প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সারাদেশের চোখ মূলত মেয়র পদে লড়াইয়ের দিকে।
প্রথমবারের মতো মেয়র পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হতে যাচ্ছে এই তিন সিটিতে। প্রচারণার শেষ মুহূর্তে মেয়র পদে মূল প্রতিদ্বন্দ্বীদের বক্তব্য-মন্তব্য, ইত্তেফাকের প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনসমূহ এবং উল্লেখযোগ্য অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরাখবর পর্যালোচনা করলে যে স্বারার্থ দাঁড়ায় তা হলো- তিন সিটিতেই জয়ের ব্যাপারে প্রবল আশাবাদী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। আর নানামুখী শঙ্কায় বিএনপি, ভোটে কারচুপির আশঙ্কা করছে দলটি।
তিন সিটিতে মেয়র পদে বিভিন্ন দলের প্রার্থী থাকলেও মূল ভোটযুদ্ধ হতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ প্রতীকের সঙ্গে বিএনপির ‘ধানের শীষ’ প্রতীকের প্রার্থীদের। বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট ছাড়াও খুলনা ও গাজীপুর- এই পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আগেরবার বিপুল ভোটে জয় পেয়েছিল বিএনপি। ইতোমধ্যে খুলনা ও গাজীপুরে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ।
ক্ষমতাসীন দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের শক্ত-বিশ্বাস, খুলনা ও গাজীপুরের মতো সোমবারের ভোটেও তিন সিটিতে মেয়র পদে ‘নৌকা’র প্রার্থীরা জয়ী হবেন। আর শঙ্কা প্রকাশ ও অভিযোগ করে বিএনপি বলেছেন, ‘খুলনা মডেল’- প্রয়োগ করে গাজীপুরের মতো হানাহানি-সংঘাতের ঘটনা না ঘটিয়েই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থা ও ভোট গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ন্ত্রণে রেখে এবং প্রতিপক্ষদের চাপে রাখার মাধ্যমে এই তিন সিটিতেও জয় নিজেদের পক্ষে নেয়ার আয়োজন করছে সরকার।
বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের ও তিন সিটিতে দলটির মেয়র প্রার্থীদের উপর্যপুরি অভিযোগের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘ভোটের আগে বিএনপি নিজেরাই নিজেদের হারিয়ে দিচ্ছে। ভোটে পরাজিত হলে যেন বলতে পারে-ভোট সুষ্ঠু হয়নি, সেজন্য আগে থেকে গ্রাউন্ড তৈরি করে রাখছে বিএনপি।’ অন্যদিকে, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, খুলনা ও গাজীপুরের মতো এই তিন সিটিতেও সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইসির নির্লিপ্ততায় পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন একটি দলের পক্ষ হয়ে কাজ করছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
আর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, এই তিন সিটির ভোট দেখে বিএনপি সিদ্ধান্ত নেবে-আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি যাবে কী যাবে না। তিন সিটিতে ভোটের নামে প্রহসন হলে বিএনপি কঠোর আন্দোলনে যাবে, এমন কথাও বলেছেন মওদুদ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এ বছরের ডিসেম্বরে (সম্ভাব্য) অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বর্তমান ইসির অধীনে এই তিনি সিটির ভোট-ই উল্লেখযোগ্য। খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোটে উল্লেখ করার মতো গোলযোগ কিংবা দৃশ্যমান বড় ধরনের কারচুপির ঘটনা না থাকলেও ওই দুটি নির্বাচনে ইসি সাধারণ ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে কি-না, সেটি বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটির নির্বাচনেও খুলনা বা গাজীপুরের দৃশ্যপটের পুনরাবৃত্তি হলে আস্থা-অনাস্থার দোলাচলে পড়তে হতে পারে বর্তমান ইসিকে। সেইদিক থেকে এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে হতে যাওয়া এই তিন সিটির ভোট ইসির জন্যও একটা চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে, এই তিন সিটির ভোটের ফলাফল জাতীয় রাজনীতির সমীকরণেও প্রভাব ফেলবে। খুলনা ও গাজীপুরের পর এবার এই তিন সিটিতেও ক্ষমতাসীনরা জয় পেলে সেটি আগামী জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের বিষয়ে একটি বার্তা হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে, খুলনা ও গাজীপুরের পর এই তিনি সিটিও, অর্থাৎ পাঁচটি সিটিই হাতছাড়া হয়ে গেলে দেশব্যাপী বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের মনোবলে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে পারে; যেটি প্রভাব ফেলতে পারে দলটির আগামীদিনের সম্ভাব্য আন্দোলন ও জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে।
এদিকে, তিন সিটিতেই প্রচার ও প্রচারণার কৌশলে এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে শুরুতেই সমর্থন জানিয়েছে এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা)। বরিশালেও শেষদিকে এসে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে দলটি। তবে জাপার ‘লাঙ্গল’ প্রতীকে মেয়র পদে এখনও মাঠে আছেন তাপস। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত না মানায় শুক্রবার তাপসকে দল থেকে বহিস্কার করেনে জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ। আর ভোটের মাত্র দু’দিন আগে, গতকাল সিলেটেও আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছে জাপা।
অন্যদিকে, তিন সিটিতেই দল ও জোটের অভ্যন্তরীণ নানা কোন্দল-দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে কাজ করতে হচ্ছে বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের। নানা চেষ্টা করেও সিলেটে জোটসঙ্গী জামায়াতের মেয়র প্রার্থীকে ভোট থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। রাজশাহী ও বরিশালেও বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামতে বেশ কয়েকদিন সময় নিয়েছে স্থানীয় জামায়াত। ভোটের হিসাব-নিকাষে এই বিষয়গুলোও ধর্তব্য বলে মনে করা হচ্ছে।