দেশের খবর: রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোডের এই জায়গার কাছাকাছিই ঘাতক বাস পিষে মারে মীম-রাজীবকে। সেই ঘটনার জের ধরে খুদে শিক্ষার্থীরা এক সপ্তাহ সড়ক নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কাঁপিয়ে রাখে দেশ। গতকাল (মঙ্গলবার) সেই সড়কেই পুলিশের গাড়ি উল্টো পথে চলতে দেখা যায়।
লেনবিধি মেনে গাড়ি চলেনি কোথাও। ডান দিকে মোড় নেওয়া নিষেধ থাকলেও সেদিকেই মোড় নিচ্ছে একের পর এক প্রাইভেট কার। অনেক শিশু বা কিশোর চালককে লেগুনা বা হিউম্যান হলার নিয়ে রাজধানীর সড়কে নামতে দেখা গেছে গতকাল মঙ্গলবার। রংচটা, অনুপযুক্ত কিছু বাসও আগের মতোই বেপরোয়া গতিতে চলছিল। স্থানে স্থানে দেখা যায় যানজট। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে এসব দৃশ্য দেখা যায়।
রাজধানীর কুর্মিটোলায় গত ২৯ জুলাই দুপুরে বেপরোয়াভাবে বাস চালিয়ে দুই শিক্ষার্থীর প্রাণ কাড়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবি জোরালো হতে থাকে। ওই দাবিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ প্রদর্শনের পাশাপাশি রাজধানীজুড়ে সড়কে শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নামে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। কয়েক দিন ধরে তারা মন্ত্রীসহ প্রভাবশালী অনেকের গাড়ির উল্টোযাত্রা রুখে দেয়। পুলিশের গাড়ির লাইসেন্সও পরীক্ষা করে তারা। সড়কে আলাদা লেনে রিকশা, প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন যানবাহন চালাতে লোকজনকে উদ্বুদ্ধ করে সুন্দর উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। শিক্ষার্থীদের এসব কাজের জন্য অভিনন্দন জানায় বিভিন্ন মহল। তবে শিক্ষার্থীদের ওই ‘অভিযান’ বন্ধ হওয়ার পর আবার বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে সড়কে।
গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর জিরো পয়েন্টে ট্রাফিক সপ্তাহ উদ্বোধন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার। এবারের ট্রাফিক সপ্তাহে মূল স্লোগান হলো ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা একটি জাতীয় সভ্যতার প্রতীক, সবাই ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, ট্রাফিক পুলিশকে সহায়তা করুন’। এই স্লোগান সামনে রেখে ট্রাফিক পুলিশ বিশেষ অভিযানে নামে।
ট্রাফিক সপ্তাহ চললেও লাইসেন্সহীন চালক ও ফিটনেসহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযানেই ব্যস্ত ট্রাফিক পুলিশ। সড়কে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করার দিকে নজর নেই তেমন। বিআরটিএর অভিযানও লাইসেন্স-ফিটনেস পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এসব অভিযানের কারণে অবশ্য রাজধানীতে গতকাল যানবাহন চলেছে ৫০ শতাংশের মতো। অভিযানের ফাঁক গলেও চলেছে ফিটনেসহীন লেগুনা, বাস, মোটরসাইকেল।
মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, দৈনিক বাংলা এলাকায় গতকাল লেন মেনে গাড়ি চলতে দেখা যায়নি। ট্রাফিক পুলিশ সপ্তাহ চললেও এসব এলাকায় পুলিশকে তেমন তৎপর দেখা যায়নি। গুলিস্তানে দুজন সার্জেন্টকে সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে গল্প করতে দেখা গেছে দুপুরে। ট্রাফিক সপ্তাহ পালন উপলক্ষে পল্টনে মুক্তাঙ্গনের উল্টোদিকে সচিবালয়ের পাশে বানানো ক্যাম্পটি গতকাল দুুপুর ১টা ৩৫ মিনিটে দেখা গেছে খালি।
দুপুর সোয়া ১টায় মতিঝিলে গিয়ে দেখা গেছে, শাপলা চত্বরের পাশে রোভার স্কাউট সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছিল। তাদের একজন ডেমরার গোলাম মস্তুফা মডেল কলেজের ছাত্র রেদওয়ান কবীর। সে জানায়, মতিঝিল এলাকায় ১৪০ জন রোভার স্কাউট সদস্য দায়িত্ব পালন করছে। তারা পুলিশকে সহযোগিতা করছেন। ট্রাফিক সপ্তাহ পর্যন্ত তাঁরা দায়িত্ব পালন করবেন। এক প্রশ্নের জবাবে এই রোভার স্কাউট বলেন, ‘আমরা জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য কাজ করছি।’
দুপুর ১২টা ২৫ মিনিটে জিরো পয়েন্টের পাশে দেখা যায় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটের বন্ধন পরিবহনের একটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-৩০০৫) জিরো পয়েন্টের দিকে চলছিল। একই সময় বাসটির পাশে তেলবাহী ট্যাংকলরিও (ঢাকা মেট্রো ঢ ৪১-০০৬৮) চলছিল। আর ট্যাংকলরির ডানদিকে সড়কদ্বীপ ঘেঁষে চলছিল কয়েকটি রিকশা। নির্দিষ্ট কোনো লেনে যানবাহন চলতে দেখা যায়নি। কিছুক্ষণ পরই দুটি মোটরসাইকেল উল্টোপথে চলতে দেখা যায়।
দুপুর ২টা ১০ মিনিটে গুলিস্তানের দিক থেকে আকাশ সুপ্রভাত স্পেশাল সার্ভিস নামের একটি বাস দ্রুতগতিতে পল্টন মোড় পেরিয়ে কাকরাইলের দিকে যাচ্ছিল। মোড় পেরোতেই বাসটি প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দেয় একটি রিকশাকে। রিকশাটি আটকে যায় বাসের সামনের বাম্পারে।
দুপুর ১টা ৪০ মিনিটে মতিঝিলে শাপলা চত্বরের পাশে দায়িত্ব পালন করছিলেন সার্জেন্ট মাহবুব শিকদারসহ আরো দুজন। একটি এফজেড নতুন মোটরসাইকেল চালিয়ে সেখানে যান এএসআই ওসমান। মোটরসাইকেলের পেছনে কোনো নম্বর প্লেট ছিল না। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা একজন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। চেকপোস্টে ধরা পড়েছে।’ মালিক কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাগজপত্র আনতে গেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে সার্জেন্ট মাহবুব শিকদার বলেন, মামলা দেওয়া হবে।
‘শৃঙ্খলা সম্ভব নয়’ : স্কুলশিক্ষার্থীরা যে শৃঙ্খলা রাজধানীর সড়কে দেখিয়েছে তেমনটি পুলিশের পক্ষে করা সম্ভব কি না জানতে চাইলে কয়েকজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, তা সম্ভব নয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সার্জেন্ট বলেন, রাস্তার চেয়ে গাড়ি বেশি। কেউ কারো কথা শুনতে চায় না। কে কার আগে যাবে তা নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। আরেক সার্জেন্ট বলেন, ‘ঢাকা শহরে যে পরিমাণ রিকশা, যদি এক লাইনে করা হয় তাহলে যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুর পর্যন্ত লাইন হয়ে যাবে। এর পরও শেষ হবে কি না সন্দেহ।’ সার্জেন্ট মাহবুব শিকদার বলেন, ‘লাখ লাখ ছাত্র নেমে রাস্তায় দায়িত্ব পালন করেছে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশ কতজন? তারা যখন রাস্তায় নেমেছিল তখন ঢাকায় ৪০ ভাগের বেশি গাড়ি চলেনি। এ কারণে পেরেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘তবে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব। এ জন্য গাড়িচালক ও রাস্তায় চলাচলকারীদের সচেতন হতে হবে। যত দিন সচেতন হবে না তত দিন সম্ভব নয়।’
ওভারব্রিজ নয় রাস্তাই পছন্দ : দুপুর সোয়া ২টার দিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের পাশের ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে অনেক নারী-পুরুষকে দেখা যায় বাসের ফাঁক গলে রাস্তা পার হতে। ওই সময় আবদুর রহিম নামের এক পথচারী অন্যদের সঙ্গে রাস্তা পেরিয়ে হাউস বিল্ডিংয়ের দিকে যান। ওভারব্রিজ ব্যবহার না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভ্যাস হয়ে গেছে ভাই। ওভারব্রিজে উঠতে ইচ্ছা করে না। ওভারব্রিজে ছিনতাই হয়। ছিনতাইকারী, মাদকাসক্তরা শুয়ে থাকে।’
সিগন্যাল বাতি জ্বলে না : মতিঝিল, দৈনিক বাংলা মোড়ে সিগন্যাল বাতি ছিল। কিন্তু গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্য অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কোনো সিগন্যাল বাতি জ্বলতে দেখা যায়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মতিঝিলে দায়িত্ব পালনকারী সার্জেন্ট মাহবুব শিকদার বলেন, ‘আমরা ম্যানুয়ালি ট্রাফিক কন্ট্রোল করছি। এসব লাইটের বিষয়ে সিটি করপোরেশন বলতে পারবে।’ পল্টন এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী সার্জেন্ট সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পল্টনে আমরা ম্যানুয়ালি ট্রাফিক কন্ট্রোল করছি।’
মতিঝিলে রাস্তা দখল করে পার্কিং : দুপুর দেড়টায় ৬৯-৭০ মতিঝিলে পাঠ্যপুস্তক ভবনের সামনে রাস্তায় দেখা গেছে উন্নয়নের জন্য একদিকের রাস্তা কেটে রাখা। সেখানে চারটি লেনের মধ্যে দুটি বন্ধ। কাটা অংশের সামনে ঢাকা মেট্রো গ-১৯-৪৭৪৪ নম্বর প্রাইভেট কারসহ বেশ কিছু গাড়ি পার্ক করে রাখা ছিল। বেশির ভাগ গাড়ির চালককে পাওয়া যায়নি। এক গাড়িচালকের কাছে পার্কিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
বিমানবন্দর সড়কে সকাল সাড়ে ১১টায় বিমানবন্দর পুলিশ বক্সের সামনে কোনো যানবাহন তল্লাশি করতে দেখা যায়নি পুলিশকে। অন্যান্য দিন তা করা হয়। বিমানবন্দরের পাশাপাশি উত্তরায়ও ছিল একই অবস্থা। তবে হাউস বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশের অভিযান ছিল। ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে জরিমানা আদায় করা হচ্ছিল। গাড়ির কাগজপত্রে ত্রুটি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় ১৯টি যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলা এবং দুই হাজার ৯৪০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
আগের দুই দিন উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের অভিযান ছিল জোরালো। তবে গতকাল ঢিলেঢালাভাব ছিল অভিযানে। সকালে উত্তরায় হাউস বিল্ডিংয়ের সামনে দেখা গেছে, ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ও সার্জেন্টরা বিভিন্ন যানবাহন আটকে কাগজপত্র পরীক্ষা করছিলেন। বিশেষ করে মোটরসাইকেলের আরোহীদের বেশি তল্লাশি করা হয়। মোটরসাইকেলের পেছনে সহযাত্রী থাকলে তার মাথায় হেলমেট না থাকলে মামলা ঠুকে দেন সার্জেন্টরা। এ নিয়ে মোটরসাইকেল আরোহীদের সঙ্গে পুলিশ সার্জেন্টদের কথাকাটাকাটি হতেও দেখা গেছে। তা ছাড়া সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালতও ছিলেন। এক সার্জেন্ট জানান, সড়কে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নাগরিক সচেতনতা ও অবৈধ যানবাহন বিরোধী অভিযান পরিচালনা করছেন ডিএমপির ভ্রাম্যমাণ আদালত। ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করার অপরাধে ১৭টি মামলা এবং দুই হাজার ৯৪০ টাকা জরিমানা আদায় করেন আদালত। ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকার দায়ে তিনজন চালক এবং ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার না করায় ১৯ জন পথচারীকে দণ্ড প্রদান করা হয়। এ ছাড়া কাগজপত্র না থাকায় আটক করা হয় একটি বাস। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সোয়া ২টা পর্যন্ত ট্রাফিক উত্তর বিভাগের সার্বিক সহযোগিতায় ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ইমরুল হাসান ওই অভিযান পরিচালনা করেন।
মোটরসাইকেল আরোহী জুলহান মিয়া বলেন, ‘আমার মোটরসাইকেলের পেছনে এক আত্মীয় ছিল। কিন্তু তার মাথায় হেলমেট ছিল না। ট্রাফিক পুলিশ আটকে এর কারণ জানতে চায়। পুলিশের কাছে ক্ষমা চেয়েও রক্ষা পাইনি। সাজেন্ট নাছোড়বান্দা। মামলা দিয়েই ছাড়ল। ২০০ টাকার জরিমানা করা হয়েছে। ব্যাংকে টাকা জমা দিতে বলেছে।’ তবে মামলা করলেও কোনো রাগ-অভিমান নেই তাঁর। শিক্ষার্থীরা যে পথ দেখিয়েছে তা যেন কার্যকর হয় সেই কামনা করেন তিনি।
অন্যদিন জসীমউদদীন রোডের সামনে অভিযান চালানো হলেও গতকাল তা দেখা যায়নি। এ প্রসঙ্গে ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ট্রাফিক সপ্তাহে পুলিশ কঠোর আছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ভিআইপি-সিআইপিও আইন অমান্য করলে কোনো রেহাই দেওয়া হবে না। শিক্ষার্থীরা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। সবাই যদি আমাদের সহায়তা করে তাহলে অল্প সময়েই ট্রাফিক সিস্টেম ভালোভাবেই চলবে। হাউস বিল্ডিংয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসায় এখানে অভিযানের চাপ কিছুটা কম। তবে অভিযান চলছে।’
বিমানবন্দর গোলচত্বরের সামনে ট্রাফিক পুলিশ পাওয়া যায়নি। তবে সার্জেন্টরা ব্যস্ত ছিলেন যানজট কমাতে। বিমানবন্দর পুলিশ বক্সের এক সার্জেন্ট বলেন, ‘লেন বাই লেন যানবাহন চালানো হচ্ছে না। এটা বাংলাদেশ। শিক্ষার্থীরা যা শিখিয়ে দিয়ে গেছে তা আমরা ভুলতে বসেছি। ট্রাফিক সপ্তাহ উপলক্ষে গতকাল অভিযান ছিল ঢিলেঢালা তা সত্য। তবে আমরা সক্রিয় আছি। মাঝেমধ্যে অভিযান চালানো হচ্ছে।’ এক ট্রাফিক কনস্টেবল বলেন, ‘আজ তেমন অভিযান হয়নি। অভিযানের মধ্যেই পথচারীরা ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করতে টালবাহানা করেছে। সবার মধ্যে সচেতনতা আসতে হবে। তাহলেই ট্রাফিক ব্যবস্থা উন্নত হবে।’
দুপুর ১টায় কাকরাইল মোড়ে ট্রাফিক কনস্টেবল আনোয়ারের হাতের ইশারায় শত শত গাড়ি থেমে যায়। সবাই ট্রাফিক সিগন্যাল মানছিল। ব্যতিক্রম ছিল শুধু সিগন্যাল ছেড়ে দেওয়ার পর বাসে যাত্রী ওঠানামায়। বাসে উঠতে গিয়ে একজনকে রাস্তায় পড়ে গিয়ে ব্যথা পেতে দেখা গেল। তাঁর নাম শরিফুল আলম। তিনি জানান, অনেকক্ষণ বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকার কারণেই তিনি ৬ নম্বর রুটের বাসে ঝুঁকি নিয়ে উঠতে গিয়েছিলেন।
দুপুরে প্রায় এক ঘণ্টা সেখানে এ রকম আরো দৃশ্য চোখে পড়ে। তবে ট্রাফিক সার্জেন্ট বা ট্রাফিক ইনন্সপেক্টরকে এ ব্যাপারে তেমন ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। দুপুর ১২টার দিকে মগবাজার মোড়সহ আশপাশের ট্রাফিক মোড়েও দেখা যায় একই রকম দৃশ্য। যদিও ট্রাফিক সার্জেন্ট গাড়ির কাগজপত্র চেক করতে ব্যস্ত ছিলেন। কাকরাইলে ট্রাফিক ইনস্পেক্টর আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ট্রাফিক আইন মেনে চলার অভ্যাস বাড়ছে। তবে যাত্রীরা বাসে ওঠার সময় নিষেধ করার পরও ঝুঁকি নিচ্ছে। কিছু সমস্যা এখনো ঠিক করা যায়নি। তবে দ্রুতই এগুলো ঠিক হয়ে যাবে। এখন বেশির ভাগ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ গাড়ির কাগজপত্র ঠিক আছে।
কাকরাইল মোড়ে বিজয়নগরের দিক থেকে আসা যাত্রীবাহী ৬ নম্বর বাসে রাস্তার মাঝখান থেকে যাত্রী ওঠাতে শুরু করে। যাত্রীরাও দৌড়াদৌড়ি করে ঝুঁকি নিয়ে বাসে ওঠে। বাসটির (ঢাকা মেট্রো-ল-১৮৬৯-২৩) চালক রমিজ উদ্দিন ও হেলপার সুলতান। চালক বলেন, সিগন্যাল ছাড়ার পরই তিনি গাড়ি ছেড়েছেন। গাড়ি ‘সাইড’ করার আগেই যাত্রীরা উঠে পড়েছে। হেলপার বলেন, যাত্রীদের নিষেধ করলেও শোনে না। এর পরই আল মক্কা ট্রেডার্স নামের একটি বাসসহ (ঢাকা মেট্রো-ব ১১৮০-৮৩) আরো অনেক যাত্রীবাহী বাসে একইভাবে যাত্রী ওঠাতে দেখা যায়। সেখানে রিকশা নিয়ে এলোমেলে দাঁড়িয়ে থাকার কারণ জানতে চাইলে রিকশাচালক মো. আলী জিন্নাহ বলেন, ‘আমরাও যাত্রী ওঠানোর জন্য আছি। আসলে আমরা নিজেরাই আইন মানি না। রিকশাওয়ালারা বেশি খারাপ।’
‘শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা চলছে’ : ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের প্রধান, অতিরিক্ত কমিশনার মীর রেজাউল আলম বলেন, ‘বিশেষ ট্রাফিক সপ্তাহের তিন দিন গেল। এখন আমরা আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করছি। লেন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা এখনই সম্ভব না। লাইসেন্স থেকে প্রতিটি আইনগত বিষয় যাচাই করছি আমরা।’ তিনি আরো বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যে অনেক কিছু সহজভাবে দেখা গেছে। তবে যখন বেশি গাড়ি থাকে তখন সামলানো কঠিন। একই সঙ্গে গাড়ির চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, আবার কাগজপত্রও যাচাই করতে হয়। এখন প্রতিটি পয়েন্টে রোভার স্কাউটে ছেলেরা সহযোগিতা করছে। মোবাইল কোর্টও চালানো হচ্ছে। আশা করছি বিশেষ সপ্তাহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।’
কাগজপত্র যাচাইয়ে তৎপর পুলিশ : বিকেল ৩টায় রাজধানীর ব্যস্ততম শাহবাগ মোড়ে দেখা যায়, গাড়ির চাপ অন্য দিনের চেয়ে তুলনামূলক কম। মাইকে বাজছে রাস্তায় গাড়ি চলাচলে বৈধ কাগজপত্র রাখার নির্দেশনা। ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে রোভার স্কাউট সদস্যরাও গাড়ি আটকে দলবেঁধে কাগজপত্র পরীক্ষায় সহযোগিতা করছে। বৈধ কাগজ না থাকলে মামলা দিচ্ছে পুলিশ। আবার কেউ কেউ মামলা না দিতেও অনুরোধ জানাচ্ছে। কড়াকড়িতে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না—এমন কথা বলে মামলা দিচ্ছে পুলিশ।
সরেজমিনে রাজধানীর মৎস্য ভবন, শাহবাগ মোড়, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট ও বিজয় সরণি ঘুরে দেখা যায়, গণপরিবহন, প্রাইভেট কার, সিএনজি ও মোটরসাইকেল ধরতে তৎপর পুলিশ। সাতটি স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা চলছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর কাউকে মামলা দিচ্ছে আবার বৈধ কাগজে ছেড়ে দিচ্ছে পুলিশ। আর রোভার স্কাউট সদস্যরা যানবাহনের ভেতর দিয়ে না চলতে জনগণকে সচেতন করছে। এদিন অন্যান্য দিনের চেয়ে গণপরিবহন চলাচল অনেক কম ছিল।
শেকৃবি প্রতিনিধি জানান, গতকাল বিকেলে রাজধানীর কলেজগেট, আসাদগেট, সংসদ ভবনসংলগ্ন আড়ংয়ের মোড়, খামারবাড়ি ও ফার্মগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কে আগের চেয়ে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরলেও শিক্ষার্থীদের দেখানো পথ পুরোপুরি মানছে না ছোট-বড় গাড়ির চালক, পথচারী এমনকি ট্রাফিক পুলিশ। প্রাইভেট কার, সিএনজি ও রিকশাকে সড়কের যেখানে-সেখানে পার্কিং করতে দেখা গেছে। রিকশাচালকদের বেশির ভাগই পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডের অর্ধেকের বেশি জায়গা দখল করে আছে রিকশাচালকরা। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল কমেছে। তবে তারা মামলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিকেল ৪টা ৩৫ মিনিটে আড়ংয়ের মোড়ে সার্জেন্ট আল আমিন বলেন, ‘লাইসেন্স ও ফিটনেসবিহীন কিছু গাড়ি এখনো চলছে। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬০ জন চালকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মোটরসাইকেল আরোহীরা ট্রাফিক রুলস মানতে চায় না।’ তবে আইন প্রয়োগে ভিআইপিদের দ্বারা আগের মতো বাধাগ্রস্ত না হওয়ায় তিনি স্বস্তি প্রকাশ করেন।
বিকেল সোয়া ৫টায় ফার্মগেট এলাকায় এ্যালাইক ট্রান্সপোর্টের ঢাকা মেট্রো ব-১৩-০০৫৪ নম্বর গাড়ির চালক মো. ওয়ালিউল্লাহ জানান, ট্রাফিক পুলিশ দ্বারা আগের মতো চাঁদাবাজির শিকার হতে হচ্ছে না। মনজুর হোসেন নামের এক যাত্রী বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে সড়কের অবস্থা সাময়িক ভালো হয়েছে। তবে এমন অবস্থা সব সময় থাকবে কি না সে ব্যাপারে তিনি শঙ্কাও প্রকাশ করেন।