দেশের খবর: জামাই-শ্বশুরের ইচ্ছায়ই এখানে সব হয়! এই দুজন ছাড়া রেলের কোনো কাজ হয় না। বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন, বিদেশ সফর—সব কিছুতেই তাঁদের হাত থাকবে। এর বাইরেও একজন আছেন। তিনি রেলের কেউ নন, কিন্তু দুলাভাই রেলের বড়কর্তা হওয়ার সুবাদে একের পর এক কাজ বাগিয়ে নিচ্ছেন। বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে গত তিন বছরে শতাধিক কিলোমিটার রেলপথ মেরামতের কাজ করেছেন শ্যালক। সোমবার বাংলাদেশ রেলওয়ে সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে রাজধানীর রেল ভবনে গেলে একাধিক কর্মকর্তা অভিযোগ করে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বজনপ্রীতি আর অনিয়মের ফলে রেল বড় রকমের ক্ষতির মুখে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, নতুন ইঞ্জিন ও বগি কেনার মাধ্যমে রেলে যাত্রীসেবার মান বহুগুণ বাড়ানো যায়। কিন্তু এদিকে কর্তৃপক্ষের নজর নেই। তাদের যত আগ্রহ ‘লাভজনক’ প্রকল্পের দিকে। এই কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘এ মুহূর্তে খুলনা রেলস্টেশনে আধুনিক ভবনের চেয়ে ইঞ্জিন দরকার, কিন্তু জোর দেওয়া হচ্ছে ভবন নির্মাণে।’
আরেকজন কর্মকর্তা রেলের মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে বলেন, ‘শ্বশুর বা জামাইয়ের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতেও সাহস পায় না রেলে। কারণ তাতে চাকরিজীবনে অনিশ্চয়তাসহ অন্যান্য হয়রানির ভয় রয়েছে।’
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বর্তমান দায়িত্বে আছেন ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। এরপর তিন বছর আট মাসে রেল সামনে না এগিয়ে পিছিয়েছে, বেগতির রেলে গতি আসার বদলে আগের চেয়েও স্থবির হয়েছে—এমনটাই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেওয়া, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বদলি, সাজা পাওয়া কর্মচারীদের শাস্তি কমানো থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন মহাপরিচালক। কেউ তাঁর মেয়ে জামাইয়ের বিরুদ্ধে কথা বললেই ‘শাস্তির ভয়’ দেখানো হয়। মেয়ে জামাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর পশ্চিম রেলে তাঁকে বদলির জন্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি।
অভিযোগ উঠেছে, নানা অজুহাতে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ‘বাণিজ্য’ করা হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে কলকাঠি নাড়ায় মহাপরিচালকের নেতৃত্বে গড়ে তোলা সিন্ডিকেট। ‘কর্মকর্তা-কনসালট্যান্ট-কন্ট্রাক্টর’ নামের ত্রিশক্তির সিন্ডিকেটের প্রধান সমন্বয়ক এখন আমজাদ। জানা যায়, আমজাদ হোসেন নিজে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। এই সুবাদে রেলের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (প্রকৌশল বিভাগ) বিভাগের কিছু কর্মকর্তাকে নিয়ে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। কনসালট্যান্সি সার্ভিসের নামে সাবেক কর্মকর্তারা প্রকল্প মূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এই বর্ধিত মূল্যের কাজ যাতে শুধু দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কেউ না পেতে পারে সে কাজটিও এই কনসালট্যান্টদের মাধ্যমে করা হয়। প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প ছকে (ডিপিপি) এমন সব শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, যাতে এই দুটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া আর কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ না পায়।
রেলের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি বিভাগ ট্রেন চলাচলের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এর মধ্যে আছে পরিবহন, সিগন্যাল ও টেলিকম, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, যান্ত্রিক, স্টোর ও বৈদ্যুতিক বিভাগ। দীর্ঘদিন অবহেলিত রেলের সুষম উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সব বিভাগের সমন্বিত উন্নয়ন পরিকল্পনা। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৭৬টি উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এগুলোর ৫০টিই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এবং তা মোট প্রকল্প মূল্যের ৮৫ শতাংশ। আর এই প্রকল্পগুলোর ৯৫ শতাংশই ম্যাক্স লিমিটেডসহ আরো একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। অথচ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ শুধু পূর্ত কাজ, রেললাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। তারা ট্রেন পরিচালনা, যাত্রীসেবা, পণ্য পরিবহন, রাজস্ব আয়, ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগন সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণ, সিগন্যালিং ব্যবস্থা উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি কোনো কাজে জড়িত নয়।
রেলের কয়েকজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, রেলওয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৬০ জনকে ডিঙিয়ে জামাতা মামুনুলকে পদোন্নতি দিয়ে পরিচালকের (সংগ্রহ) মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছেন মহাপরিচালক। সব দরপত্র আহ্বান ও মালপত্র কেনা হয় মামুনুলের দপ্তর থেকে। জানা যায়, দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামুনুলের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। আমজাদ তা ধামাচাপা দিয়েছেন। আমজাদ দায়িত্ব নেওয়ার পর মামুনুল রেকর্ডসংখ্যকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন। গত ৩ থেকে ১২ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে তাঁকে জাপান পাঠানো হয়।
জানা গেছে, মামুনুলের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী অপপ্রচার এবং বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর রেল ভবনে এক সভায় রেলমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক মামুনুলকে রেল ভবন থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বদলি করার তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশও বাস্তবায়ন করা হয়নি।
মামুনুল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি ৯ মাস ধরে বর্তমান পদে কাজ করছি। তদবির, সুপারিশের অভিযোগ তোলা হচ্ছে যোগ্য মহাপরিচালক ভালো কাজ করছেন বলে। রেলে মহাপরিচালকের সমান্তরাল কেউ নেই। আমার চেয়ে বেশি বিদেশ ভ্রমণকারী অনেক জুনিয়রও আছেন।’
আমজাদের শ্যালক ঠিকাদার মো. বদরুল আলমের বাড়ি সিরাজগঞ্জের নতুন ভাঙ্গাবাড়ীতে। জানা যায়, বদরুলকে কাজ দেওয়ার জন্য মহাপরিচালক নিজে বারবার কর্মকর্তাদের ফোনে নির্দেশনা দেন। পশ্চিমাঞ্চলের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্মকর্তাদের সহায়তায় বদরুল গত তিন বছরে শতাধিক কিলোমিটার রেলপথ মেরামতের কাজ করেন। যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে তিনি কাজ করেন এর মধ্যে আছে—১. মো. বদরুল আলম, নতুন ভাঙ্গাবাড়ী, সিরাজগঞ্জ, ২. মেসার্স এইচ কে ট্রেডিং, হাউস নং-১৪৪, শিরোইল ঘোড়ামারা, রাজশাহী, ৩. মো. আব্দুল কাইয়ুম, পাকশী, পাবনা, ৪. এশিয়া এন্টারপ্রাইজ, গৌরহাংগা, ঘোড়ামারা, রাজশাহী, ৫. মেসার্স মামুন ট্রেডিং, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী ও ৬. মেসার্স জারমান আলী, শিরোইল কলোনি, ঘোড়ামারা, রাজশাহী।
অভিযোগ রয়েছে, বদরুল রেলের বাতিল বা স্ক্র্যাপ মালামাল সংগ্রহ করেন ঢাকার মেসার্স হামিদ স্টিল করপোরেশন, দ্য ন্যাশনাল আয়রন স্টিল ওয়ার্কস ও মেসার্স মাসুদ ইস্পাত ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে এবং এগুলো দিয়েই রেললাইন মেরামতের কাজ করে থাকেন। ফলে কাজের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হচ্ছে।
তবে বদরুল আলম বলেন, ‘দুলাভাই ডিজি হওয়ার পর আমি তাঁর অফিসে যাইনি। কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করিনি যাতে আমার দাপট প্রকাশ পায়। আমি ২৮ বছর ধরে রেলে ঠিকাদারি করছি। পাথর, স্লিপার সরবরাহ করি। এখন নাটোরে তেলের গাড়ি রাখার লুপ লাইন তৈরির কাজ ও খুলনায় গ্রিড-৪-এর কাজ করছি। তার আগে সিরাজগঞ্জে স্টেশন ভবন করেছি। আমি কখনো স্ক্র্যাপ কিনিনি, ব্যবহার করিনি। যারা অভিযোগ দিচ্ছে তারা মিথ্যা বলছে।’
দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণে ২০১৬ সালের অক্টোবরে ১৫০টি মিটার গেজ কোচ কিনতে উন্নয়ন প্রকল্প ছক তৈরি করা হয় রেলভবন থেকে। কর ও ভ্যাট ছাড়া এগুলোর দাম ধরা হয় ৬৭৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। অথচ এডিবির ঋণে একই ধরনের কোচ কেনায় ব্যয় হয় ৫২৭ কোটি টাকা। কোচগুলো কেনায় ১৫১ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়। রেলের কোচ কেনায় ভ্যাট ও কর বাবদ ৪০ শতাংশ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়। এ হিসাবে ১৫০টি কোচ কেনায় ভ্যাট-কর দিতে হবে ৬০ কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২১১ কোটি টাকা। প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে মহাপরিচালকের নির্দেশনানুসারে। এ বিষয়ে রেলের পরিকল্পনা শাখার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তাঁর নির্দেশ ছাড়া কোনো কাজ করি না। তিনি অনুমতি দিলেই তা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠাই।’
রেলভবন ঘুরে জানা যায়, ডিজির জামাতা ‘ম্যানেজ’ হলে আর কোনো কর্মকর্তাকে পেছনে তাকাতে হয় না। উচ্চাভিলাষী অনেক কর্মকর্তা এ সুযোগটি নিচ্ছেনও। প্রধান প্রকৌশলী পদে পদোন্নতির জন্য ৪০ লাখ, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদের জন্য ৩০ লাখ, বিভাগীয় প্রকৌশলী পদের জন্য ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার অলিখিত নিয়ম চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য পদভেদে ১০ থেকে ২০ লাখ টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ আছে।
ডিজি যা বললেন : এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রেলের মহাপরিচালক (ডিজি) আমজাদ হোসেন অস্বীকার করেন। মো. আমজাদ হোসেন বলেন, তিনি কোনো সিন্ডিকেট গড়েননি। মেয়ের জামাইয়ের কোনো প্রভাব নেই। বরং মেয়ের জামাইয়ের পদোন্নতি তিনি আটকে রেখেছেন নিজে ‘নিরপেক্ষ’ থাকার জন্য। শ্যালক বদরুল আলম ৩০ বছর ধরেই ঠিকাদারি করছে দাবি করে তিনি বলেন, বদরুল গত পাঁচ বছরেও তাঁর দপ্তরে আসেনি। তাঁর ভাষায় : ‘আমার মেয়ের জামাইকে দেখলে কেউ বলবে না সে কোনো অনিয়ম করছে।’
তিনি বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর সিন্ডিকেট গড়েছেন কি না জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, ‘বিনিয়োগের বড় অংশ চলে যায় পাথর আমদানি, পরামর্শকদের পেছনে ব্যয়ের আয়কর ও ভ্যাট আর ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ। পাথরে শুল্ক দিতে হয় ৭৪ শতাংশ, বিদেশি ও দেশি পরামর্শক ব্যয়ে যাথাক্রমে ৩৫ ও ২৭ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। বিনিয়োগ প্রকল্পের ৪০-৫০ শতাংশই চলে যায় ভ্যাট-ট্যাক্সে। আমি কেন সিন্ডিকেট করব? আমি রেলের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সব বিভাগের কাজেই আন্তরিক।’
একটি নতুন ইঞ্জিনের দাম ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে ১০০টি ইঞ্জিন কিনতে দরকার মাত্র তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা। অথচ এই ১০০টি নতুন ইঞ্জিন কেনা হলে বাংলাদেশ রেলের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কয়েক গুণ বেড়ে যেত। তা কেন করা হয়নি জানতে চাইলে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘৪৬টি ইঞ্জিন কেনা হয়েছে। আরো ১০০টি আসবে। ২৭০টি কোচ আমদানি করা হয়েছে। আরো ১০০০টি আসবে। তখন রেলের চেহারা পাল্টে যাবে।’ কেন ইঞ্জিন ও কোচ আনার প্রকল্প কম তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একা প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে জড়িত নই।’ বদলি বাণিজ্যের অভিযোগও অস্বীকার করেছেন আমজাদ।
তবে রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সিনিয়রদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি দেওয়ার পর আবারও পদোন্নতির সুযোগ আছে মামুনুুলের জন্য, কিন্তু রেলভবনে কমিশন বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতেই পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। তবে এ অভিযোগ সত্য নয় দাবি করে আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমাকে দুর্বল করার জন্য অবসরে যাওয়া একটি মাফিয়া চক্র আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে অভিযোগ দিচ্ছে। আমি আজই অবসরে যাওয়ার আবেদন করছি।’
সূত্র: যুগান্তর অনলাইন।