অনলাইন ডেস্ক: বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে শিগগিরই বড় ধরনের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের তালিকা প্রস্তুত করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর-মাউশি। এ তালিকা নিয়ে আগস্টের শেষ সপ্তাহে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে শিক্ষা ক্যাডারের ‘বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটি’র (ডিপিসি) সভা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। শিগগিরই আরেকটি সভা অনুষ্ঠিত হবে। এবার প্রায় এক হাজার কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। যদিও এই ক্যাডারে এ মুহূর্তে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তা রয়েছেন প্রায় সাড়ে চার হাজার।
এ ব্যাপারে মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে শিগগিরই ডিপিসি সভায় বসে এ বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। এদিকে, পদোন্নতির খবরে সারাদেশের সরকারি কলেজগুলোতে শিক্ষকরা নড়েচড়ে বসেছেন। দীর্ঘদিন পর তারা পদোন্নতির খবর পেয়ে আশায় বুক বেঁধেছেন।
পদোন্নতির তালিকা নিয়ে অভিযোগ: শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা জানান, তিনভাবে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়োগ পান। সরাসরি বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে, বেসরকারি কলেজ থেকে আত্তীকরণ এবং রাষ্ট্রপতির ১০ শতাংশ কোটায়। এই ক্যাডারের কর্মকর্তারা সরকারি কলেজে সরাসরি শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ সার্ভিস রুল ১৯৮১-এর ৫, ৬ ও ৭ বিধি অনুযায়ী, শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদোন্নতির জন্য পাঁচ বছর, সহযোগী অধ্যাপকের জন্য তিন বছর এবং অধ্যাপক পদের জন্য দুই বছর অর্থাৎ ফিডার পদে ১০ বছর থাকতে হবে। ফিডার সার্ভিস বলতে শিক্ষা ক্যাডারের মূল পদ সরকারি কলেজে কর্মরত থাকতে হবে। এ ছাড়াও সব ক্যাডার পদে নিয়োগপ্রাপ্তদের শুরুতে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষায় পাস ও শিক্ষানবিশকাল শেষ করে চাকরি স্থায়ীকরণ বাধ্যতামূলক। পদোন্নতির জন্য পরীক্ষায় পাসও বাধ্যতামূলক। যারা এসব যোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হবেন, তাদের চাকরির মেয়াদ ১৫ বছর পূর্ণ হলে পরীক্ষা প্রমার্জন সাপেক্ষে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু এসব আইন ভঙ্গ করে ২০০৬ সাল থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। এতে শিক্ষা ক্যাডারে চরম অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। আদালতে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। তার পরও মাউশি আবারও বিধি লঙ্ঘন করে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির খসড়া তালিকা চূড়ান্ত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগস্টের শেষ সপ্তাহে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সভাপতিত্বে ‘বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটির সভা হয়। সেখানে প্রস্তাবিত তালিকা থেকে বিষয়ভিত্তিক ২০ শতাংশ সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তালিকায় পদার্থবিদ্যার ৪৯, পরিসংখ্যানে দুই, প্রাণিবিদ্যায় ৬৩, বাংলায় ৮০, ব্যবস্থাপনায় ৬৯, ভূগোলে সাত, মৃত্তিকা বিজ্ঞানে তিন, মনোবিজ্ঞানে চার, রসায়নে ৪২, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ৭৮, সমাজবিজ্ঞানে ১৩, সমাজকল্যাণে ২৯, সংস্কৃতে এক, হিসাববিজ্ঞানে ৬৩, অর্থনীতিতে ৮১, আরবিতে আট, ইসলামী শিক্ষায় ২৭, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে ৭২, ইংরেজিতে ৭৯, ইতিহাসে ৭৯, উদ্ভিদবিদ্যায় ৭৮, গার্হ্যস্থ অর্থনীতিতে ছয়, গণিতে ৫৯ এবং দর্শনে ৮৫ জন রয়েছেন। এ ছাড়া টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ইতিহাসে একজন, ভূগোলে একজন, বিজ্ঞানে একজন, শিক্ষা নয়জন, গাইডেন্স অ্যান্ড কাউন্সিলিং বিষয়ে একজন রয়েছেন।
মাউশি জানায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত অধ্যাপকদের অবসরে যাওয়ার তালিকা হিসাব করে ১৯টি বিষয়ের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য এক হাজার ৯১ জনের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সারাদেশের সরকারি কলেজের বর্তমানে ৯৮টি অধ্যাপক পদ শূন্য রয়েছে। আর ডিসেম্বরে আরও ৮০ জন অবসরে যাবেন। মাউশির হিসাব মতে, ১৭৮টি পদে অধ্যাপকের পদোন্নতি যোগ্য। তবে গত বছরের ১০ নভেম্বর ২৭৪ জনকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৫৮ জন আগের পদে বহাল আছেন।
বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা ক্যাডারে বিসিএস পরীক্ষায় পাস না করেও আত্তীকৃত শিক্ষক, পরিদর্শক থেকে পদোন্নতিসহ বিভিন্নভাবে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। বিধি অনুযায়ী, শিক্ষা ক্যাডারের জ্যেষ্ঠতা নির্ধারিত হবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে যোগদানের তারিখ থেকে। পদোন্নতির খসড়া তালিকা করার ক্ষেত্রে এ বিধানও মানা হয়নি। নিয়ম মেনে পদোন্নতি না দেওয়ায় ৭ম থেকে ১৪তম বিসিএস পর্যন্ত শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন। এবারের পদোন্নতির তালিকায় বিভাগীয় পরীক্ষায় পাসসহ নিয়মিত পদোন্নতিপ্রাপ্ত ও মেধাবীদের নাম রয়েছে অপেক্ষাকৃত নিচের দিকে। এতে করে তারা পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। মাউশির এক শ্রেণির কর্মকর্তারা অর্থের বিনিময়ে অযোগ্যদের তালিকার শীর্ষে রাখছেন বলেও অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা।
এ ব্যাপারে মাউশির মহাপরিচালক বলেন, কিছু ব্যক্তি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। পদোন্নতির যোগ্যতায় কারও ঘাটতি থাকলে তাকে পদোন্নতি দেওয়া হবে না। পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো রকম অনিয়ম হবে না।
চাকরিবিধি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে গত সাত বছরে প্রায় এক হাজার বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করেছেন। কারও আবার চাকরিই স্থায়ী হয়নি। তবুও অধ্যাপক হয়েছেন। এসব পদোন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশির একটি সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে কলকাঠি নেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে অবৈধভাবে পদোন্নতি দিতে গিয়ে বলি দেওয়া হয়েছে পদোন্নতিযোগ্য প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তাকে।
২০০৬ থেকে ২০১৭ সালের অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জ্যেষ্ঠতা তালিকা, ফিট লিস্ট বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ও ২৩ অক্টোবর দুই দফায় ৫৮৭ পদোন্নতিপ্রাপ্ত অধ্যাপকের মধ্যে ১৫৪ জন বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষায় ফেল করা। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর পদোন্নতিপ্রাপ্ত ৩৬৭ অধ্যাপকের মধ্যে দুই শতাধিক ফেল করা ও ১৪৮ জন পদোন্নতির অযোগ্য ছিলেন। শর্ত পূরণ না করায় তাদের চাকরিও স্থায়ী হয়নি। তবুও তারা অধ্যাপক হয়েছেন।
কারা পাবেন পদোন্নতি: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশ হলো, পদোন্নতিযোগ্য যত বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া যায়, দিতে হবে। সে লক্ষ্যে তারা কাজ করছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কলেজ উইং থেকে জানা গেছে, তদবিরের চাপ এড়াতে এবার পদোন্নতি আদেশের সঙ্গে সঙ্গেই পদায়নও করা হবে। অধ্যাপক পদে বিভিন্ন বিষয়ে এবার প্রায় আড়াইশ’ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হবে। যদিও মাউশি এক হাজার ৮১ জনের একটি খসড়া তালিকা প্রস্তুত করেছে। এর বাইরে রিজার্ভ পদের বিপরীতেও পদোন্নতি দেওয়া হবে। অধ্যাপক পদের জন্য বিসিএসের ১৪তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের এবার বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। এই ব্যাচে প্রায় ১৮০০ কর্মকর্তা থাকলেও ১১৭০ জন পদোন্নতিযোগ্য। তবে এই ক্যাডারে বিষয়ভিত্তিক শূন্যপদের বিপরীতে পদোন্নতি দেওয়া হয় বিধায় মাউশির তৈরি করা পদোন্নতিযোগ্য এই ১১৭০ জনের মধ্যে সর্বোচ্চ ২০০ জনের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়তে পারে।
উল্লেখ্য, এই ব্যাচের বেশিরভাগ কর্মকর্তা ২০১৩ সাল থেকে অধ্যাপকের স্কেলে বেতন পাচ্ছেন। তাদের পদোন্নতি দেওয়া হলে সরকারের কোনো ব্যয় বাড়বে না। আর সহযোগী অধ্যাপক পদে প্রায় ৩০০ জন এবার পদোন্নতি পাবেন। সহযোগী অধ্যাপক পদে এবার বিসিএসের ১৭, ১৮ ও ২০, ২১ ও ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তারা ডিপিসির বিবেচনায় রয়েছেন।
অন্যদিকে, প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে এবার প্রায় ৫০০ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। সহকারী অধ্যাপক হওয়ার জন্য এবার বিসিএসের ২৭, ২৮, ২৯ ও ৩০তম ব্যাচের কর্মকর্তারা বিবেচিত হচ্ছেন। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পদোন্নতির তালিকা চূড়ান্ত করা হলে সেদিনই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এবারের পদোন্নতি সম্পর্কে এই কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি’র সভাপতি অধ্যাপক আইকে সেলিমউল্লাহ খন্দকার বলেন, তাদের ক্যাডারের প্রায় সাড়ে চার হাজার কর্মকর্তা বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করে বসে আছেন। তাদের কারও কারও পদোন্নতি দেওয়া হলে তাতেও সরকারের ব্যয় বাড়বে না। অথচ পদশূন্যতার অভাবে তাদের পদোন্নতি দেওয়া যাচ্ছে না। এজন্য নতুন পদ সৃষ্টি করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এনাম কমিটির সুপারিশ অনুসারে তাদের ক্যাডারে আরও সাড়ে ১২ হাজার পদ প্রাপ্য রয়েছে। এসব পদ সৃষ্টির জন্য তারা সরকারের কাছে দাবি করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে এই প্রস্তাবও সরকারের সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বিবেচনাধীন।
বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজের শিক্ষকরা জানান, তাদের একই পদে ১২ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত চাকরি করতে হয়। পদোন্নতির জন্য আর কোনো ক্যাডারে এভাবে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হয় না। এ বিষয়ে সেলিমউল্লাহ খন্দকার বলেন, ১৪তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা ২৫ বছর ধরে চাকরি করেও এখনও অধ্যাপক হতে পারেননি। এই বঞ্চনা সহ্য করার মতো নয়।
জানা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারে দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি বঞ্চনা চলছে। অন্যসব ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দেওয়া হলেও এই ক্যাডারে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতি দেওয়া হয়। ফলে বিভিন্ন কলেজে জুনিয়ররা চাকরিতে সিনিয়রদের ওপরে উঠে গেছেন।
মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, দেশের ৩২৭টি সরকারি কলেজসহ সংশ্নিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকের পদ রয়েছে ১৫ হাজার ১১২টি। এর মধ্যে বর্তমানে শূন্য রয়েছে প্রায় তিন হাজার পদ। এর প্রায় সবই ঢাকার বাইরের উপজেলা ও মফস্বল এলাকার কলেজের। এর বাইরে সম্প্রতি আরও ২৭৬টি বেসরকারি কলেজকে সরকারিকরণ করা হয়েছে।