ন্যাশনাল ডেস্ক: দিনক্ষণ, প্রস্তুতি সব ঠিক থাকলেও শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশ মিয়ানমারে যেতে রাজি না হওয়ায় ঝুলে গেল প্রত্যাবাসন। বরং মিয়ানমারে নিরাপত্তাসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে তারা।
জানা গেছে, প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ায় উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার মদদে ও কিছু উচ্ছৃঙ্খল রোহিঙ্গাদের পরিকল্পিত হুমকি-ধামকির কারণে প্রত্যাবাসন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
উখিয়া সংবাদদাতা জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম দিন উখিয়ার থাইংখালীর জামতলী জি-৮ ব্লক ও টেকনাফের উনচিপ্রাং ক্যাম্পের ১৬টি রোহিঙ্গা পরিবারের প্রত্যাবাসন করার কথা ছিল। তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের উখিয়ার পার্শ্ববর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তের ট্রানজিট পয়েন্ট দিয়ে ফেরত পাঠানোর সকল প্রস্তুতি ছিল। দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে সেখানে উপস্থিত রোহিঙ্গাদের জানানো হয়, তাদের জন্য অন্তত তিনদিনের খাবার-দাবার ও জরুরি প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ বাসে করে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করা হয়েছে। এরপর তাদের বাসে ওঠার আহবান জানালে ‘যাব না’ বলে স্লোগান দেওয়া শুরু করে তারা। ইত্তেফাকের টেকনাফ সংবাদদাতা জানান, উনচিপ্রাং ক্যাম্পে বিক্ষোভ করে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গারা বলতে থাকে, ‘এখন আমরা ফিরব না’, ‘গণহত্যার বিচার চাই’, ‘নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাই’, ‘স্বদেশের বসত ভিটা ফেরত চাই’। বিক্ষোভে ক্যাম্পের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠে। উখিয়ার থাইংখালী জামতলী জি-৮ ব্লকে অবস্থানরত প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম থাকা রোহিঙ্গা নারী হামিদা খাতুন (৫৫) বলেন, ‘আমরা নির্যাতিত হয়ে এদেশে আশ্রয় নিয়েছি। সে দেশে ফিরে আবারো নির্যাতিত হতে চাই না।’ প্রত্যাবাসন তালিকায় থাকা আবুল কালাম (৩৫) বলেন, কিছু দিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাম্পে এসে আমাদের নাম-ঠিকানা নিয়ে যায়। ক’দিন পর এসে বলে আমাদেরকে মিয়ানমার ফেরত যেতে হবে। এতে আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। রাতে দেখি আমার বউ ও মেয়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেছে। জোরপূর্বক প্রত্যাবাসিত হওয়ার আশঙ্কায় তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের অনেকে ঘর ত্যাগ করেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের আপত্তি ও প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ১৫ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) ঠিক ছিল। তবে রোহিঙ্গারা সাড়া না দেওয়ায় প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের দাবি স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। এ কারণে মিয়ানমারে ফিরে যেতে ইচ্ছুক নয় রোহিঙ্গারা। তিনি আরো বলেন, আমরা তো আর জোর করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে পারব না। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
জানা গেছে, গতকাল কক্সবাজারে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর কর্মকর্তারা বৈঠক করেন প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান জানান, প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনে সাড়া না দিয়ে উল্টো প্রত্যাবাসন বিরোধী সমাবেশ ও মিছিল করে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করে। রোহিঙ্গারা যেতে রাজি না হওয়ায় ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী লম্বাশিয়া গ্রামের বাসিন্দা নূরুল ইসলাম বলেন, কতিপয় এনজিও সংস্থা ও উচ্ছৃঙ্খল রোহিঙ্গাদের হুমকি-ধামকির কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। অন্যথায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত সহিংসতা ও নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। সে সময়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে মিয়ানমার। চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে। এই গ্রুপের তৃতীয় বৈঠকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে আট হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠায়। যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমার ওই তালিকা থেকে ৫ হাজার ৫শ’ জনকে প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র দেয়। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম ধাপে ২ হাজার ২৫১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। প্রতিদিন ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেওয়া হবে বলে জানায় মিয়ানমার। এদিকে দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার পর জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে অপরিণত ও বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেছে। তারা প্রত্যাবাসনকে স্বেচ্ছায় ও নিরাপদ করার আহবান জানিয়েছে। প্রত্যাবাসন স্থগিত রাখার আহবান এইচআরডব্লিউর:রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন পরিকল্পনা স্থগিত রাখার আহবান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। সংস্থাটি জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকর্তাদের সুপারিশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে। সংগঠনটির শরণার্থী অধিকার বিষয়ক পরিচালক বিল ফ্রেলিক বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো শুরু করলে বাংলাদেশ খুবই দ্রুত আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাবে। শরণার্থী শিবিরে সেনা মোতায়েন করার ঘটনা থেকেই বোঝা যায় যে, ভীত রোহিঙ্গা সম্প্রদায় প্রত্যাবাসনে আগ্রহী নয়। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গাদের নিজেদের ইচ্ছায় হবে বলে বলা হলেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য উত্সাহ দেওয়া হচ্ছে। ক্যাম্পের একজন শরণার্থী হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেন, এই প্রত্যাবাসন জোরপূর্বক এবং আমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ক্যাম্পের একটি মানুষও ফিরে যেতে চায় না। কানাডার উদ্বেগ:নিজ দেশে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের প্রতি আহবান জানিয়েছে কানাডা। দেশটি আরো বলেছে, তড়িঘড়ি করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত হবে না। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী ক্লদিয়ে বিবুই এক যৌথ বিবৃতিতে এ আহবান জানান। তারা এই প্রত্যাবাসন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
পূর্ববর্তী পোস্ট