দেশের খবর: শীতের সকালে তখনো কুয়াশা পুরোপুরি কাটেনি। মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজের সামনে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঢাকা-১৩ আসনের এই কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোটগ্রহণ চলছে। নতুন পদ্ধতিতে ভোট দেওয়ার আগ্রহে কাদেরাবাদ হাউজিং এলাকার মেইন রোডের ২ নম্বর বাড়ির দারোয়ান বাবুল মিয়া (৫৮) সবার আগেই চলে এসেছেন। সকাল সোয়া ৮টার দিকে ভোট দিয়ে বেরিয়ে তিনি জানালেন, মেশিনে ভোট দেওয়া খুব সহজ। একবার দেখিয়ে দিলেই ভোট দিতে পেরেছেন। একই কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ফিরছেন চল্লিশোর্ধ্ব জাহেদা আক্তার। তিনি জানান, প্রথমবার ভুল হলেও দ্বিতীয়বারে তিনি ভোট দিতে পেরেছেন। দুই মিনিটের মধ্যেই তাঁর ভোট দেওয়া শেষ হয়েছে।
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের পাশের ভাড়াটিয়া পপি খাতুন (২৮) জানান, অতি সহজেই তিনি ভোট দিতে পেরেছেন। আঙুলে ছাপ মিলিয়ে গোপন বুথে গিয়ে তিনি ভোট দিয়েছেন। তবে ভিড় থাকায় তাঁর এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পপি খাতুনের মতো বেশির ভাগ ভোটারই ইভিএমে ভোট দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। তারা বলছে, এটি প্রযুক্তিবান্ধব। এই যন্ত্রে ভোট হবে ঝামেলাবিহীন। এতে লম্বা লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়নোর ঝামেলা নেই। অল্প সময়ে ভোট দেওয়া হয়ে যায়। তবে আঙুলের ছাপ দিতে ঝামেলা হওয়া, ইভিএমের গোপন কক্ষেও একটি দলের এজেন্টদের উপস্থিতি এবং ভয়ভীতি দেখানো, দলের প্রতীকের বোতামে চাপ দিতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন অভিযোগও পাওয়া গেছে। আবার ইভিএম মেশিনসংক্রান্ত জটিলতা বা মেশিনটি পরিচালনায় কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অদক্ষতায় কিছু কেন্দ্রে ভোটগ্রহণে বিঘ্ন ঘটার চিত্রও দেখা গেছে।
এ ছাড়া ভোটকেন্দ্রগুলোতে প্রার্থীদের এজেন্টদের উপস্থিতি ছিল কম। বেশির ভাগ কেন্দ্রে শুধু নৌকা প্রতীকের এজেন্ট দেখা গেছে। কোথাও কোথাও হাতপাখা মার্কার এজেন্ট দেখা গেলেও অন্য প্রতীকের এজেন্ট দেখা যায়নি। দুপুরের আগে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন কেন্দ্রের সামনে দেখা গেছে নৌকা সমর্থকদের ভিড়। তারাই তাঁবু টাঙিয়ে ভোটারদের ভোটার স্লিপ দিয়ে সহযোগিতা করছেন। আর তাঁবু তো দূরের কথা, কোথাও অন্য কোনো প্রার্থীর পোস্টারও দেখা যায়নি।
একই চিত্র পাওয়া গেছে, ঢাকা-৬ আসনের কেন্দ্রগুলোতে। নাজিরাবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে কথা হয়, ৬৭ বছর বয়সী বৃদ্ধ খলিলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, সাদা আর সবুজ বাটন চেপে নিমেষেই ভোট দিলাম।
ওই কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের তিন ও চারতলার কক্ষে পুরুষদের ও নিচতলায় নারীদের জন্য ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে। পাশেই মেয়র হানিফ কমিউনিটি সেন্টারে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে ভোটার উপস্থিতি বেশ কম লক্ষ করা গেছে। কেন্দ্রে লাঙল মার্কার পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে। কিন্তু অন্য দলের পোলিং এজেন্টদের দেখা যায়নি। ওই আসনের কেন্দ্রগুলো থেকে এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ধানের শীষের সমর্থকরা। বলেছে, এমনকি তাদের কেন্দ্রের আশপাশে দাঁড়াতেও দেওয়া হয়নি।
ঢাকা-৬ আসনে অভিনব কায়দায় ভোট কারচুপির হচ্ছে বলে অভিযোগ করে গণঐক্যের প্রার্থী ববি হাজ্জাজ বলেন, ‘আমরা তো আগে ভেবেছিলাম মেশিন ম্যানিপুলেশন হবে। এখন তো ভোটকেন্দ্রই দখল হচ্ছে। দুই ভাবে ইভিএমের কেন্দ্রে ভোট কারচুপি করা হচ্ছে। বুথে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে লাঙল মার্কার লোকেরা ভোটারকে কোথায় ভোট দেবেন, তা জানতে চাচ্ছেন। অনেককে জোর করে লাঙলে ভোট দেওয়ানো হয়েছে।’ ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে একটি কেন্দ্রে এক প্রার্থীর এজেন্টকে কাজী ফিরোজ রশীদ নিজেই মেরে বের করে দিয়েছেন বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
ঢাকা-৬ আসনে মহাজোট থেকে লাঙলের প্রার্থী কাজী ফিরোজ রশীদ। কিন্তু ভোটের পরিবেশ, বিশেষ করে ইভিএমে ভোট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন, ভোটের পরিবেশ দেখে আমি অখুশি। ভোট সুষ্ঠু হচ্ছে না। আমার আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু সব কেন্দ্রেই ইভিএমে জটিলতা দেখা দিয়েছে। আঙুলের ছাপ কাজ করছে না। সুষ্ঠু ভোট হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ইভিএম নিয়ে খুশি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন। দুপুরে নাজিরা বাজার ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে বলেন, নতুন পদ্ধতি ভোট গ্রহণ হলেও সকাল থেকে সবাই সানন্দে ভোট দিচ্ছে। নতুন ভোটারদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। এই পদ্ধতি অনিয়মের কোনো সুযোগ নেই। ইভিএম নিয়ে বিরোধী দলের আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
যদিও ইভিএম ব্যবহারের জটিলতায় পড়েন ঢাকা-১৩ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. সাদেক খান। তিনি সকাল ৯টার দিকে মোহাম্মাদিয়া আলিয়া মাদরাসায় ভোট দেন। এ সময় প্রথমবার ইভিএমে তাঁর আঙুলের ছাপে জটিলতা হয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার ইভিএম তার আঙুলের ছাপ শনাক্ত করে। এ বিষয়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা জানান, শীতকালে রুক্ষ ত্বক ও নারীদের বিভিন্ন গৃহস্থালি কাজের ফলে অনেকের আঙুলের ছাপ নিতে জটিলতা দেখা দিচ্ছে। তবে আঙুলের ছাপ না মিললেও স্মার্ট কার্ড ও ভোটার আইডি নম্বর দেখে ভোটার শনাক্ত করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনো জটিলতা নেই।
ঢাকা-৬ আসনে গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেন। আর ঢাকা-১৩ আসনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগের মো. সাদেক খান ও বিএনপির আবদুস সালামের মধ্যে। এই দুটি আসন ছাড়াও চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ ও সাতক্ষীরা-২ আসনে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হয়। এই ছয়টি আসনে ৮৪৫টি কেন্দ্রের পাঁচ হাজার ৩৮টি ভোট কক্ষে ইভিএম যন্ত্রের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়। সেখানে মোট ভোটারসংখ্যা ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৪৪ জন। ঢাকার বাইরের আসনগুলোতেও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণের খবর পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রামের ভোটারদের উচ্ছ্বাস : চট্টগ্রাম থেকে জানা যায়, জীবনের প্রথম ভোট, সেটাও ইভিএম মাধ্যমে, স্বাভাবিকভাবেই দারুণ উচ্ছ্বাস ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইসমেত আঞ্জুমের। চট্টগ্রাম-৯ কোতোয়ালি আসনের জামালখান এলাকার ডা. খাস্তগীর স্কুলের মহিলা কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়ে ভোটের মাধ্যমে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন তিনি। কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার সময় এক প্রশ্নের জবাবে ইসমেত আঞ্জুম বলেন, ‘নিজেকে দেশের একজন নাগরিক বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোনো সিদ্ধান্তে আমিও মত দিতে পেরেছি।’
এই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. নূরুন নবী জানান, ‘আঙুলের ছাপ মেলানো থেকে শুরু করে ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সর্বোচ্চ দুই মিনিট সময় লাগছে। তবে কোথাও কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
চট্টগ্রাম-৯ আসন ঘুরে মোটামুটি ইভিএম নিয়ে স্বস্তির খবরই পাওয়া গেছে। তবে লোকপ্রশাসন কেন্দ্রে দুটি ভোটকক্ষে ইভিএম মেশিনে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পরে ব্যাকআপ ইভিএম মেশিন দিয়ে আবারও ভোটগ্রহণ শুরু হয়। তবে বেশ কিছু এলাকায় ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। আবার বিএনপি এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগও এসেছে।
যন্ত্রে ভোট মজার: খুলনা অফিস থেকে গৌরাঙ্গ নন্দী জানান, জীবনের প্রথম ভোট, তাও যন্ত্রে। নির্দিষ্ট বুথের যন্ত্রটি বিকল হওয়ায় দুই দুইবার ফিরে এসে তৃতীয়বার গিয়ে ভোট দিতে পেরেছেন জাহানারা। এতেও তিনি বেজায় খুশি। ভোট দিতেও কোনো ঝামেলা হয়নি। যন্ত্রে আইডি নম্বর প্রবেশ করালে পরিচিতি চলে আসে, তারপর ভোটগ্রহণ কক্ষে গিয়ে বোতাম চেপে ভোট প্রদান করেন। সব কিছু মিলে খুবই উচ্ছ্বাস তাঁর। জানালেন, ‘যন্ত্রে ভোট, খুবই মজার।’
খুলনা মহানগরীর ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের নূরানিয়া মাদরাসা কেন্দ্রের একটি বুথে যন্ত্র বিকল হওয়ার কারণে ভোটগ্রহণে কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। ঘণ্টা দুই ওই বুথের জন্য নির্দিষ্ট ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। আবারও যন্ত্র সচল হলে ভোট প্রদান হয়। সকাল ৮টা বাজতে না বাজতেই এই কেন্দ্রে ভোটারদের সারি পড়ে। তবে অনেক জায়গায় বিএনপি প্রার্থীর এজেন্ট দেখা যায়নি, তাদের নির্বাচনী তাঁবুও দেখা যায়নি।
সাতক্ষীরায় ভোটার স্লিপ বিড়ম্বনা: ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটাররা সহজে দিতে পারলেও ভোটার স্লিপ নিয়ে নির্দিষ্ট বুথে ভোট দিতে বিড়ম্বনায় পড়েন। বিশেষ করে নারী ভোটারা বেশি এই বিড়ম্বনার শিকার হন। তবে ইভিএমে ভোট দিতে পুরুষদের চেয়ে নারী ভোটারদের উপস্থিতি বেশি লক্ষ করা গেছে। মৃগীডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও রাজনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুপুরে মেশিনে ত্রুটি দেখা দেওয়ায় কিছু সময়ের জন্য ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। পরে টেকনিশিয়ান নিয়ে মেশিন চালু করে ফের ভোটগ্রহণ শুরু করা হয়।
এদিকে সাতক্ষীরা পল্লী মঙ্গল স্কুল কেন্দ্রে শাহনারা পারভীন, মারুফা বেগম, আরিফা বেগম ও রাজিয়া সুলতানাসহ কয়েকজন নারী ভোটার বলেন, সকাল থেকে ভোট দিতে লাইন শুধু লম্বা হচ্ছে। ভোটার নম্বর খুঁজে না পাওয়ায় এমনটি হয়েছে বলে তাঁরা জানান।
রংপুরে মেশিন বিকল: রংপুর থেকে জানা যায়, ইভিএম বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন সাধারণ ভোটাররা। এমনকি ইভিএম বিকল হওয়ায় একটি কক্ষের ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল সাড়ে ৪ ঘণ্টা। নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের নুরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার জাহাঙ্গীর হাসান জানান, তাঁর কেন্দ্রে ছয়টি ভোটকক্ষের মধ্যে একটিতে শুরু থেকেই ভোট দিতে পারেননি। এই কক্ষে মোট ভোটার ছিল ৪৩৩ জন। তিনি বলেন, মেশিন বিকল হওয়ার পর রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক এনামুল হাবীব ওই কেন্দ্রটি পরিদর্শন করেন। সাড়ে ১২টার দিকে সেখানে নতুন মেশিন আনা হয়। এরপর ওই কক্ষে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এ ছাড়া, মুলাটোল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে আব্দুল হামিদ সরকার নামের এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ভোট দিতে পারেননি। ওই কেন্দ্রের পাঁচটি কক্ষের সবকটিতে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র মেশিনে প্রবেশ করিয়েও কাজ হয়নি। ফলে তাঁকে ভোট না দিয়েই ফিরতে হয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে মেশিনে আঙুলের ছাপ অস্পষ্ট হওয়ায় অনেক কেন্দ্রে সময়ক্ষেপণ হয়েছে।