দেশের খবর: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এবার সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে। সরকারি দলের টিকিট কেটে তৎপর দেড় শতাধিক নারী নেত্রী। দশম জাতীয় সংসদের আওয়ামী লীগ দলীয় সংরক্ষিত নারী এমপিদের প্রায় সবাই এবারও একই পদ ধরে রাখতে জোর লবিং শুরু করেছেন।
পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নারীনেত্রীরাও এই পদে আসতে চাইছেন। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নারীরা নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে। এছাড়া চলচ্চিত্র, সঙ্গীত ও নাট্যজগতের নামিদামি তারকাসহ সংস্কৃতিকর্মী এবং অন্যান্য পেশার নারীরাও সংরক্ষিত নারী এমপি পদে মনোনয়ন চাইছেন।
সূত্রমতে, নারী এমপি পদে আসতে ইচ্ছুকদের মধ্যে অনেকে গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গেও দেখা করেছেন। প্রায় প্রতিদিনই তারা গণভবনে ভিড় জমাচ্ছেন। তবে গত সংসদগুলোতে সংরক্ষিত নারী এমপি পদে যারা নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা এবার দলের মনোনয়ন পাবেন না বলে নিজের নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ হিসাবে বর্তমান সংরক্ষিত নারী এমপিদের সিংহভাগই বাদ পড়ে যাচ্ছেন। তাদের জায়গায় জেলা কোটা পূরণে বিভিন্ন জেলার নারীনেত্রীদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী এমপি পদে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সংরক্ষিত নারী এমপি হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার উপযোগীদের নাম চূড়ান্ত করছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ত্রিশজন নারীনেত্রীর নাম চূড়ান্ত করেছেন শেখ হাসিনা, যাদের সংরক্ষিত নারী এমপি পদে মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে।
জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) নির্বাচন আইন-২০০৪ অনুযায়ী, নির্বাচনের ফলাফলের গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যে সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) দল ও জোটওয়ারী তালিকা তৈরি করবে এবং ভোটার তালিকা ইসিতে টানিয়ে দেবে। এরপর ৩০০ আসনের বিপরীতে ৫০টি সংরক্ষিত আসনে দল কিংবা জোটের অনুকূলে বরাদ্দ করা হবে। গেজেট প্রকাশের নব্বই দিনের মধ্যে সংরক্ষিত নারী এমপি নির্বাচন শেষ করতে হবে ইসিকে। গত ১ জানুয়ারি ইসি এবারের নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করেছে। এ হিসাবে ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই সংরক্ষিত নারী এমপি পদে নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু এবং ২৯ মার্চের মধ্যে এ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে।
তবে সোমবার নতুন মন্ত্রিসভা গঠন ও শপথ গ্রহণের পরপরই সংরক্ষিত নারী এমপি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে ইসি সূত্র জানিয়েছে। সে অনুযায়ী নারী এমপি নির্বাচনের তফসিলও ঘোষণা করা হবে। নতুন এমপিদের একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে যোগদানের লক্ষ্যে মধ্য ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন ও শপথ সম্পন্ন করার সম্ভাবনা রয়েছে। ২১ বা ২২ জানুয়ারি এই সংসদের প্রথম অধিবেশন বসতে পারে।
জাতীয় সংসদে তিনশ’ জন সরাসরি নির্বাচিত হন। এরপর নির্বাচিত হন ৫০ জন সংরক্ষিত নারী এমপি। সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে প্রতি আসনের বিপরীতে সংরক্ষিত নারী আসন দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ১৬৭টি। অর্থাৎ প্রায় প্রতি ছয়টি আসনের জন্য একটি দল ও জোট একজন করে সংরক্ষিত নারী এমপি পাবে। এ পদ্ধতিতে এবার আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচিত ২৫৭ জন এমপির জন্য প্রায় ৪৩ জন সংরক্ষিত এমপি পাবে। জাতীয় পার্টি ২২ জন নির্বাচিত এমপির বিপরীতে চারজনের মতো নারী এমপি পাবে। এবার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের ২৮৮ জন নির্বাচিত সংসদের বিপরীতে ৪৮টি আসন পাওয়ার কথা।
সংসদে ১৪ দল ও মহাজোট শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বিকল্পধারা, বাংলাদেশ জাসদ, তরীকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি (জেপি) এবং স্বতন্ত্র প্রতিনিধিত্বও রয়েছে। তবে তাদের কারও আসন তিনের বেশি নয়। ফলে তাদের সংরক্ষিত নারী এমপি পেতে হলে জোট থেকে পেতে হবে। এ ছাড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত সাতজন এমপি রয়েছেন, যাদের পাঁচজন বিএনপির ও দু’জন গণফোরামের।
দশম সংসদের সংরক্ষিত নারী এমপি পদে আছেন- এমন অনেকেই এবার সরাসরি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে তাদের কাউকেই একাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তারা এবার সংরক্ষিত এমপি পদে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হচ্ছেন- তথ্য প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা, শ্যামপুর-কদমতলী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সান্জিদা খানম, মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শিরীন নাঈম পুনম, সহসভাপতি নাসিমা ফেরদৌসী, সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নূরজাহান বেগম মুক্তা, যুব মহিলা লীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি সাবিনা আক্তার তুহিন, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফজিলাতুন নেসা বাপ্পি, সাবেক আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাভানা আক্তার, ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সেলিনা জাহান লিটা, আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, মাহজাবিন খালেদ বেবী, ওয়াসিকা আয়েশা খান, অ্যাডভোকেট উম্মে কুলসুম স্মৃতি এবং আখতার জাহান। সংরক্ষিত নারী এমপিদের মধ্যে নিলুফার জাফর উল্লাহ ও রোকসানা ইয়াসমিন ছুটিসহ আরও কয়েকজন মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে জোরালো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।
দশম সংসদের অপর দুই সংরক্ষিত নারী এমপি ন্যাপের কার্যকরী সভাপতি আমেনা আহমেদ ও জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য লুৎফা তাহের এবং নবম সংসদের সংরক্ষিত এমপি গণতন্ত্রী পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য রুবী রহমানও আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের মনোনয়নে আবার এমপি নির্বাচিত হতে পারেন বলে আলোচনা রয়েছে।
দশম ও নবম সংসদের এমপিদের মধ্যে বরিশালের জেবুন্নেছা আফরোজ, মৌলভীবাজারের সায়েরা মহসীন ও কুষ্টিয়ার সুলতানা তরুণসহ কয়েকজন সংরক্ষিত নারী এমপি পদে দলীয় মনোনয়ন পেতে পারেন। আওয়ামী লীগের নারীনেত্রীদের মধ্যে সংরক্ষিত নারী এমপি হতে চাইছেন দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, শামসুন রাহার চাঁপা, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যাবিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সদস্য পারভীন জামান কল্পনা ও মারুফা আক্তার পপি।
সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদে থাকা নারী নেত্রীদের মধ্যে মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাফিয়া খাতুন, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদা বেগম কৃক, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি শাহিদা তারেখ দীপ্তি, সাধারণ সম্পাদক শবনম জাহান শিলা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সাবেরা বেগম, সাধারণ সম্পাদক নারগিস রহমান, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক অপু উকিল, মহিলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রওশন জাহান সাথী এবং তাঁতী লীগের কার্যকরী সভাপতি সাধনা দাশগুপ্তা সংরক্ষিত নারী এমপি পদের জন্য জোরালো দাবিদার। তবে আগে কখনও ওই পদে না আসা মাহমুদা বেগম ক্রিক, সাধনা দাশগুপ্তা এবং শবনম জাহান শিলার দলের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে সূত্র জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার দলের কয়েকজন নেতা ও প্রয়াত নেতার স্ত্রীকে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি পদে নিয়ে আসছেন বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের স্ত্রী ও ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জাকিয়া পারভীন খানম, অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রয়াত এম এ আজিজের স্ত্রী রাবেয়া আজিজ, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও কবি প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিলের স্ত্রী অ্যাডভোকেট নীলুফার আনজুম পপি, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের প্রয়াত সভাপতি বজলুর রহমানের স্ত্রী শিরিন আক্তার এবং বঙ্গবন্ধুর চাচাত ভাই শেখ হাফিজুর রহমান টোকনের স্ত্রী শেখ এ্যানি রহমান।
সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে নাট্যাভিনেত্রী খেলাঘরের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শমী কায়সার এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরীকেও একাদশ সংসদে সংরক্ষিত নারী এমপি হিসেবে দেখা যেতে পারে।
এ ছাড়া সংরক্ষিত নারী এমপি পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক প্রতিমন্ত্রী জিনাতুন নেছা তালুকদার, মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসমা জেরিন ঝুমু, আজিজা খানম কেয়া, সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর আলেয়া পারভীন রনজু, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমা হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জান্নাত আরা হেনরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ইসমত আরা হ্যাপী, দপ্তর সম্পাদক রোজিনা নাসরীন, সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা সভাপতি সাবেক সংরক্ষিত নারী এমপি চেমন আরা তৈয়ব, যুব মহিলা লীগের সহসভাপতি জাকিয়া পারভীন মনি, আদিবা আঞ্জুম মিতা, শামীমা চৌধুরী মিতা, কোহেলী কুদ্দুস মুক্তি, আশরাফুন্নেছা পারুল, ডেইজী সারোয়ার, আফরোজা মনসুর লিপি, কেশোয়ারা সুলতানা সালমা, ইয়াসমীন সুলতানা পপি, ইসরাত জাহান নাসরীন, আফরোজা হাসান ডেইজী, পারভীন খায়ের, নার্গিস মাহতাব, শারমীন জাহান মেরী, আফসানা ফেরদৌস কেকা, সহ-শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পাঠাগার বিষয়ক সম্পাদক সরকার ফারহানা আখতার সুমী, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমীন ঝুমা, স্বেচ্ছাসেবক লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নিঘাত পারভীন, রাজশাহী জেলা মহিলা লীগ সভাপতি মর্জিনা পারভীন প্রমুখ। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক মনিরা আক্তার মনির নামও জোরালো আলোচনায় রয়েছে।